Ami Tarashis Bolchi

Ami Tarashis Bolchi
The blog of Tarashis Gangopadhyay (click the photo to reach our website)

Thursday 25 April 2024

তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা "মহাপ্রভুর নীলাচলে আজও চলে লীলা" বইটি থেকে মহাপ্রভুর অন্তর্ধান বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের একটি ভাগ আমাদের পাঠক বন্ধুদের জন্যে তুলে দেয়া হল

#জয়_মা_তারা_পাবলিশার্স 

আমাদের জয় মা তারা পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত
লেখক তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা "মহাপ্রভুর নীলাচলে আজও চলে লীলা" বইটি থেকে  মহাপ্রভুর অন্তর্ধান বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের একটি ভাগ আমাদের পাঠক বন্ধুদের জন্যে তুলে দেয়া হল।

---------------------------------------

সমুদ্রের বুক থেকে অনাবিল বাতাস ভেসে আসছে। সামুদ্রিক বাতাসের শীতল নোনা স্পর্শে জুড়িয়ে যাচ্ছে মনপ্রাণ। কিন্তু মুখর ব্রহ্ম সাগরের সামনে বসে বেশীক্ষণ তো মৌন থাকা যায় না। আর মধুপর্ণা তেমন পাত্রীও নয়। অতএব ব্যালকনিতে এসে বসতে না বসতেই সে উত্থাপন করল আলোচনার প্রসঙ্গ, “আচ্ছা দাদা, দুপুরবেলায় তো বলছিলে যে সন্ধ্যায় বালানন্দ তীর্থাশ্রমে ফিরে শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্দ্ধান নিয়ে তোমার বিশ্লেষণের কথা বলবে। তা এখন কি ওই বিষয়টা নিয়ে একটু আলোচনা করা যায়?"

আমি বলি, "কেন যাবে না? এসব আলোচনা করার মত আদর্শ পরিবেশেই তো বর্তমানে আছি। আশেপাশে কোন লোকজনও নেই। তাই সুজয়েরও দ্বিধাগ্রস্ত হওয়ার কারণ নেই।” বলতে বলতেই সুজয়ের দিকে চাই আমি, "কি ভাই, ঠিক বললাম তো?”

সুজয় হাসে, "আসলে কি জানো - পুরীতে শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্দ্ধান রহস্যের বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর বিষয় বলেই মানা হয়। আর তাই উন্মুক্ত সড়কে এই রহস্য নিয়ে মুক্তকণ্ঠে আলোচনা করতে গেলে প্রাণ নিয়ে টানাটানি হতে পারে। অতীতে পুরীধামে বসে এই বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে গবেষক লেখক ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায় তো অজানা আততায়ীদের হাতে খুন হয়েছিলেন। তাঁর বৃদ্ধা মাও তাদের আক্রমণে আহত হয়েছিলেন। আমি চাইনি তখন প্রকাশ্য রাজপথে এই বিষয়ে আলোচনা করে আমাদের ক্ষেত্রে সেই 
ঘটনার পুনরাবৃত্তির কোন সামান্যতম সম্ভাবনাও দেখা দিক। তবে বর্তমানে এখানে বসে নিরিবিলিতে সেই আলোচনা তো করাই যেতে পারে।"

আমি বলি, “ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের কথা আমিও জানি। তিনি যে শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্দ্ধান রহস্য নিয়ে গবেষণা করতে করতে অনেকটা গভীরে চলে গিয়েছিলেন তা আমারও অজানা নয়। তাঁর 'কাঁহা গেলে তোমা পাই' গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে উপন্যাসের আড়ালে তিনি তাঁর সেই গবেষণাই তুলে ধরেছিলেন। ১৯৭৭ সালে সেটি প্রথম প্রকাশিত হয় 'ঝাড়গ্রাম বার্তা'-য়। গ্রন্থটি যেখানে তিনি শেষ করেছিলেন তাতে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে আর দুটো প্রমাণ পেলেই তিনি ঘোষণা করবেন কারা সেদিন শ্রীচৈতন্যদেবকে হত্যা করেছিলেন এবং কোথায় সমাহিত করা হয়েছে তাঁর মরদেহ। অর্থাৎ 'কাঁহা গেলে তোমা পাই'-এর দ্বিতীয় খণ্ডেই তিনি সবকিছু জানাবেন। কিন্তু কোন অজানা কারণে দ্বিতীয় খণ্ডটি পরবর্ত্তী আঠেরো বছরের মধ্যে আর প্রকাশিত হয়নি এবং ১৯৯৫ সালে তিনি গুপ্তহত্যার শিকার হন। তাই আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল যে প্রথম খণ্ড বেরোনোর পরও তিনি তো আঠেরো বছর জীবিত ছিলেন। এর মধ্যে পরের খণ্ডটি তিনি প্রকাশ করলেন না কেন? এ বিষয়ে 'কাঁহা গেলে তোমা পাই' গ্রন্থের প্রকাশক প্রাচী পাবলিকেশনের কর্ণধার জয়দীপবাবুকেও আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি জানিয়েছিলেন ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায় দ্বিতীয় খণ্ডের পাণ্ডুলিপিও প্রস্তুত করেছিলেন যথাযথ প্রমাণসহ। কিন্তু সেটি প্রকাশ করার আগেই অজানা আততায়ীর হাতে তিনি নির্মমভাবে খুন হন এই পুরীধামেই। আর তখনই খোয়া যায় পাণ্ডুলিপিসহ সব প্রমাণ। অতএব এই বিষয়টি নিয়ে পুরীধামের প্রকাশ্য রাজপথে কথা বলতে না দিয়ে ভালই করেছ তুমি।"

আমার সমর্থন পেয়ে খুশী হয় সুজয়। তবে মধুপর্ণা প্রশ্ন তোলে, "কিন্তু ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের গবেষণা তো নিশ্চয়ই মানুষকে সত্যেরই পথ দেখাত। যে মহাপ্রভুর প্রেমের জোয়ারে বাংলা ও উড়িষ্যার বুকে হল ভক্তির নবজাগরণ সেই প্রেমাবতারের স্থূলদেহের অন্তর্দ্ধান রহস্য সম্বন্ধে জানার আগ্রহ ও অধিকার তো প্রতিটি মানুষেরই আছে। তাহলে যে গবেষক সেই সত্যসন্ধানে অগ্রসর হয়েছিলেন তাঁকে এভাবে হত্যা করার কারণ কি?”

সুজয় বলে, "ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের গবেষণায় যে মৌচাকে ঢিল পড়েছিল। মৌচাকে ঢিল পড়লে কি আর মৌমাছিরা চুপ করে থাকে?"

-"কিন্তু ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায় যে সময়ে এই গবেষণা করছিলেন তখন থেকে প্রায় ৪৫০ বছর আগের একটি রহস্যের উপর আলোকপাত হলে কার কি আসত যেত?” 

  -"কারো যে আসত যেত তাতো বলাই বাহুল্য। নাহলে কেনই বা তাঁর দ্বিতীয় খণ্ডের পাণ্ডুলিপি চুরি যাবে? আর কেনই বা তিনি অকালে খুন হবেন?"

-"কিন্তু তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী কারা? কারা তাঁকে এভাবে হত্যা করল?"

-"তার কোন সদুত্তর নেই। আর যখন কোন হত্যাকাণ্ডের সদুত্তর পাওয়া যায় না তখন কাউকে এ বিষয়ে দোষী সাব্যস্ত করাও ঠিক নয়। তবে সন্দেহের তীরটা যায় সেইসব মানুষের বংশধরদের দিকে যাঁরা একদিন আপন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য প্রেমাবতার শ্রীচৈতন্যদেবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে শোনা যায় পুরীর একটা সম্প্রদায় এখনো এ বিষয়ে গবেষণা অপছন্দ করে। আর তাই কেউ এ বিষয়ে গবেষণা করতে গেলে তাদের প্রাণে মেরে ফেলতেও দ্বিধা বোধ করে না। সেজন্যই ডঃ নীহাররঞ্জন রায় বলেছিলেন, 'শ্রীচৈতন্যের দেহাবসান কিভাবে ঘটেছিল সে সম্বন্ধে আমার কিছু যুক্তিনির্ভর ধারণা আছে। কিন্তু সে ধারণাটি আমি প্রকাশ্যে বলতে বা লিখতে পারব না ; যদি বলি বা লিখি বঙ্গদেশে প্রাণ নিয়ে বাঁচতে পারব না। অতএব ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের অকালমৃত্যু কেন হয়েছিল তা তো আন্দাজ করতেই পারছ।"

-"তাহলে শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্দ্ধান রহস্য নিয়ে গবেষণাই তাঁর অকালমৃত্যুর কারণ! কিন্তু প্রশ্ন হল শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্দ্ধান রহস্য কি উদ্‌ঘাটন করা একেবারেই অসম্ভব? এই সত্যান্বেষণ কি কোনদিনই সম্ভব হবে না?"

সুজয় এবার রণে ভঙ্গ দিয়ে আমার দিকে চায়। অতএব আমি মৃদু হেসে মধুপর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে বলি, "আমার প্রিয় বোনটি, এপ্রসঙ্গে প্রথমেই বলি সত্যান্বেষণের প্রথম শর্তই হল যে আগে ঘটনার গতিপ্রকৃতি দেখে বুঝতে হবে সেটি আদৌ অপরাধ না দুর্ঘটনা। যদি ঘটনাটিকে বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে এটি অপরাধ তখন দেখতে হবে এর মধ্য থেকে কি সূত্র পাওয়া যায়। সেই সূত্র ধরে বের করতে হয় অপরাধীর মোটিভ। একমাত্র তারপরই আসা যায় উপসংহারে।"

মধুপর্ণা বলে, "তবে ঘটনার গতিপ্রকৃতি একটু বিশ্লেষণ করেই বল না কেন! সত্যান্বেষীর মগজাস্ত্র একটু চালনা নাহয় করলে তোমার বোনটির জন্য! দেখাই যাক না রহস্য উদ্‌ঘাটনের কতটা কাছে পৌঁছনো যায়?"

সুজয় হাসে, "আর এতো তোমার যে সে বোন নয়। রীতিমত বন্য বোন। অনুরোধ করলেও সেটা আদেশেরই নামান্তর হয়ে ওঠে।"

আমিও হাসি সুজয়ের কথায়। বলি, "বোনেরা একটু এমনটিই হয়। আর তাদের সাথে বনিবনা ঠিক রাখতে গেলে তাদের আবদারও রাখতেই হয়। সে আবদার যতই 'বন্য' হোক না কেন তাকে 'বোন্য' বলেই সম্মান দিতে হয়।" তারপর বোনের আবদার রাখার কাজ শুরু করি। মধুপর্ণাকে জিজ্ঞাসা করি, "আচ্ছা বল তো, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অন্তর্দ্ধান প্রসঙ্গে সকলে কি বলে থাকেন?"

মধুপর্ণা বলে, "সকলে তো বলেন তিনি জগন্নাথদেবের মধ্যে লীন হয়ে গেছেন। কিন্তু তাই কি কখনো হতে পারে? কারোর স্থূলদেহ কি কখনো বিগ্রহের মধ্যে লীন হয়ে যেতে পারে?"

আমি বলি, "হতে পারে না বলে কিছুই নেই এই পৃথিবীতে। যোগশক্তিতে সকলই সম্ভব। জীবনে আমি যত অলৌকিক লীলা প্রত্যক্ষ করেছি তাতে আমি নিশ্চিত যে প্রেমাবতার শ্রীচৈতন্যদেব যদি তেমনটিই চাইতেন তবে তাও করতে পারতেন। অবতারের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। কিন্তু তিনি যদি তেমনটাই চাইতেন তবে তিনি ভক্তদের সেই ইঙ্গিত দিয়ে যেতেন এবং তাঁর ভক্তরাও তাঁদের প্রাণপ্রিয় মহাপ্রভুর সেই ইঙ্গিত লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। কিন্তু বৈষ্ণব কবিদের রচনায় তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। আর তাছাড়া এটাও দেখা গেছে যে অবতার এবং অবতারবরিষ্ঠ মহাত্মারা পৃথিবীতে অবতীর্ণ হলে নিজে সবকিছুর অতীত হওয়া সত্ত্বেও জন্ম-মৃত্যুসহ গ্রহদের সকল বিধানই মাথা পেতে নেন এবং স্বাভাবিক নিয়মেই দেহত্যাগ করেন। স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরামকৃষ্ণদেব এর উদাহরণ। এই শ্রীকৃষ্ণের কথাই ধর না কেন! ভেবে দ্যাখো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণের মত মহারথীদের হাজার হাজার বাণ যে শ্রীকৃষ্ণের দেহে বিদ্ধ হওয়াসত্ত্বেও তাঁর কোন ক্ষতি হয়নি সেই শ্রীকৃষ্ণই জরা ব্যাধের মত সামান্য এক ব্যাধের তীরের আঘাতে প্রাণত্যাগ করেছেন। এর অর্থ কি? পৃথিবীতে নির্দিষ্ট সময়ের লীলাখেলা শেষ হলে একটি ছুতোর প্রয়োজন হয় যেটিকে মাধ্যম করে অবতার দেহ রেখে ফিরে যান অমৃতলোকে। অর্থাৎ প্রকৃতির নিয়মমত প্রকৃতির দেহ ত্যাগ করে স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুকে মেনে নেন সকল অবতার। মর্য্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র, লীলা পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ, শিবাবতার বামাক্ষ্যাপা, সচল শিব ত্রৈলঙ্গস্বামী, যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ প্রভৃতি সবাই মেনেছেন প্রকৃতির নিয়ম। তাই শ্রীচৈতন্যদেবই বা ব্যতিক্রম হতে যাবেন কেন? দেহ তো আত্মার কর্মভূমিমাত্র। একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এতে আবির্ভূত হয়ে লোককল্যাণের কাজ করেন অবতার আর তারপর কাজের সময় অতিক্রান্ত হলে মাটির দেহ মাটিতেই ফিরিয়ে দিয়ে তিনি চলে যান তাঁর জন্য নির্দিষ্ট লোকে। তাই আমার বিশ্বাস শ্রীচৈতন্যদেবও প্রকৃতির সেই বিধান লঙ্ঘন করেননি।”

-"তাহলে বৈষ্ণব কবিরা কেন বলে আসছেন যে মহাপ্রভু 'জগন্নাথ অঙ্গে লীন' হয়ে গেছেন?"

আমি বলি, "এইমাত্র তুমি যে তত্ত্বটি বললে মহাপ্রভুর অন্তর্দ্ধান রহস্যের আলোচনায় ওটিই হচ্ছে মূল সূত্র। আর এই সূত্র ধরেই আমরা এগোব রহস্যের কিনারার দিকে।"

সুজয় অবাক হয়, "তার মানে?

আমি বলি, "মানেটা খুব সহজ। কিন্তু সেটা এখনই বলব না। বলব ঘটনাটি বিশ্লেষণ করার পর। তাহলে আমার সাথে সাথে তোমাদেরও মগজাস্ত্র সেদিকে চালনা করতে সুবিধা হবে। তাই প্রথমেই আসা যাক ঘটনার বিশ্লেষণে। দেখা যাক শ্রীচৈতন্যদেব কিভাবে লীন হয়ে গিয়েছিলেন জগন্নাথদেবের বিগ্রহের মধ্যে। এ প্রসঙ্গে তাঁর ঠিক সমসাময়িক ভক্তরা কিন্তু মুখ খোলেননি। যদিও অনেকেই চৈতন্য-জীবনী লিখেছেন কিন্তু শ্রীচৈতন্যলীলার সবকিছু সুচারুভাবে বর্ণনা করলেও তাঁর দেহরক্ষার প্রসঙ্গে এসে তাঁরা দুয়েক লাইনে উপসংহার টেনেছেন। মুরারী গুপ্তের কড়চা তার অনুপম নিদর্শন। তারপর আসা যাক কৃষ্ণদাস কবিরাজের কথায়। তিনি তাঁর 'চৈতন্য চরিতামৃত' গ্রন্থে অন্তঃলীলার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিলেও মহাপ্রভুর অন্তর্দ্ধান প্রসঙ্গে নীরবতা বজায় রেখে উপসংহারে লিখেছেন

'শেষ লীলার সূত্রগণ
    কইল কিছু বিবরণ
   ইহা বিস্তারিতে চিত্ত হয়।     থাকে যদি আয়ুঃশেষ
 বিস্তারিব লীলাশেষ
  যদি মহাপ্রভুর কৃপা হয়।'

অর্থাৎ এখানেও যে সব বলা হয়নি তা স্বীকার করে নিয়েছেন ভক্তপ্রবর কৃষ্ণদাস কবিরাজ। তাঁর তথা অন্য গৌড়ীয় বৈষ্ণব কবিদের এই অন্তর্দ্ধান লীলার বিষয়ে এহেন তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই যে মহাপ্রভুকে ওখানেই পাণ্ডারা গুম-খুন করেছে তবে তাঁর মরদেহ গেল কোথায়? অত সত্বর তো তাঁর দেহ সমাহিত করা সম্ভব নয়। বিশেষতঃ বাইরে যখন দাঁড়িয়ে আছে তাঁর অগণিত ভক্ত। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে লোচনদাসকে এমন একটি অবিশ্বাস্য তত্ত্ব কেন লিখতে বলা হল? তবে কি নরহরি ঠাকুর এই ঘটনার মধ্য দিয়ে কোন তাত্ত্বিক ইঙ্গিত দিতে চেয়েছিলেন যা সেইসময়ে যথাযথভাবে প্রকাশ করা সম্ভব না হলেও যাতে পরবর্তীকালে সেই ইঙ্গিতটিকে সূত্র হিসেবে নিয়ে তদন্ত করা হয়? তাহলে সেই ইঙ্গিত কি? তবে কি তিনি রহস্যের মাধ্যমে বলতে চাইছেন যে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর এই অন্তর্দ্ধান লীলা একমাত্র পাণ্ডারাই জানেন এবং তাঁরাই ঘোষণা করেছেন এহেন সিদ্ধান্ত?" এই পর্যন্ত বলে আমি থামলাম।

মধুপর্ণা বলে, “বেশ ইন্টারেস্টিং বিষয় তো! তাহলে লোচনদাসের কাহিনীটিকে একটি সূত্র হিসেবেই ধরতে হবে?"

আমি বলি, "অবশ্যই। তার পরের সূত্র দিচ্ছেন জয়ানন্দ। তাঁর 'চৈতন্যমঙ্গল'-এ কিন্তু বদলে গেছে মহাপ্রভুর অন্তর্দ্ধানস্থল। তিনি লিখেছেন - মহাপ্রভু দেহরক্ষা করেছেন গদাধর পণ্ডিতের সাধনক্ষেত্র তোটা গোপীনাথে। এবার তাঁর রচনা পর্যালোচনা করে দেখা যাক। তিনি লিখছেন-
 'আষাঢ় বঞ্চিতা রথ বিজয় নাচিতে।
  ইঁটাল বাজিল বাম পায়ে আচম্বিতে।।
  ...চরণে বেদনা বড় ষষ্ঠীর দিবসে।
  সেই লক্ষ্যে তোটায় শয়ন অবশেষে।।
   পণ্ডিত গোসাঞিকে কহিল সর্বকথা।
  কালি দশ দণ্ড রাত্রে চলিব সর্বথা।।
  মায়া শরীর তথা থাকিল ভূমে পড়ি।
   চৈতন্য বৈকুণ্ঠ গেলা জম্বুদ্বীপ ছাড়ি।।'

অর্থাৎ জয়ানন্দের 'চৈতন্যমঙ্গল' বলছে আষাঢ় মাসের পঞ্চমীতে রথযাত্রার সময়ে ভাবাবেশে নাচতে নাচতে মহাপ্রভুর বাঁ পা গিয়ে পড়ে ইঁটের উপরে। সেই ইঁটের ঘায়ে যে ক্ষত হয় সেই ক্ষত অচিরেই বিষিয়ে ওঠে পরদিন ষষ্ঠীতে। সেই বাঁ পায়ের ক্ষত বিষাক্ত হয়ে ওঠায় তাঁর শরীরে বাসা বাঁধে সেপটিক জ্বর। সেইসময়ে শ্রীচৈতন্যদেবের পরম ভক্ত গদাধর পণ্ডিত তাঁকে নিয়ে আসেন তোটা গোপীনাথের মন্দিরে। সেখানে মহাপ্রভু দেহরক্ষা করেন। জয়ানন্দের এই তত্ত্বটি পরবর্ত্তীকালে সমর্থন করেছেন নিত্যানন্দবংশীয় শ্যামলাল গোস্বামী। তিনি লিখেছেন- 'একদিন রথাগ্রে নৃত্য করিতে করিতে প্রভুর পদনখে আঘাত লাগিল। উক্ত আঘাতকে ছল করিয়া প্রভু লোকলীলা সংবরণের অভিলাষ করিলেন।' 
     নরহরি চক্রবর্ত্তির 'ভক্তিরত্নাকর' গ্রন্থেও লেখা আছে-
  'ওহে নরোত্তম এই স্থানে গৌরহরি।
  না জানি পণ্ডিতে কি কহিল ধীরি ধীরি।।
  প্রবেশিলা এই গোপীনাথের মন্দিরে।
  হৈলা অদর্শন পুনঃ না আইলা বাহিরে।।

ওড়িয়া কবি সদানন্দ কবিসূর্য্য ব্রহ্মও তাঁর 'প্রেমতরঙ্গিনী' কাব্যে মহাপ্রভুর অন্তর্দ্ধানের বিষয়ে লিখেছেন -
  'অষ্ট চালিশ বরষে অন্তর্দ্ধান টোটা গোপীনাথ স্থানে।'

  কিন্তু তৎকালীন বৈষ্ণব সমাজ এই মতটিকে গ্রহণ করেননি। ইতিহাসবিদরা বলে থাকেন যেহেতু অবতারের লৌকিক মৃত্যু হলে তাঁর মহিমা ক্ষুন্ন হয় সেজন্যই এই মত তাঁরা মানেননি। কিন্তু আমি বলব মহামতি বৈষ্ণব আচার্য্যরা এই মত গ্রহণ করেননি সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। যাঁদের উপাস্য স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ লৌকিক জগৎ থেকে অন্তর্দ্ধানের জন্য লৌকিক মৃত্যু বরণ করেছেন তাঁরা শ্রীচৈতন্যদেবের ক্ষেত্রেও এমনটিই হয়ে থাকলে মানবেন না কেন? আসলে এই মতটি যে একান্তই অবিশ্বাস্য। যে মহাপ্রভুর একান্ত ভক্ত রাজা প্রতাপরুদ্র, মন্ত্রী রামানন্দ, রাজগুরু কাশী মিশ্র, সভাপণ্ডিত সার্বভৌম ভট্টাচার্য্য সেই মহাপ্রভু পঞ্চমীতে আহত হয়ে ষষ্ঠীতে ভুগে সপ্তমীতে বিনা চিকিৎসায় দেহরক্ষা করবেন এটা একান্তই হাস্যকর তথ্য। যদি সত্যিই তেমনটি হত তবে রাজা প্রতাপরুদ্রসহ অন্য শীর্ষস্থানীয় ভক্তরা মহাপ্রভুর জন্য উড়িষ্যার কবিরাজ চিকিৎসকদের ভিড় করে আনতেন তোটায়। কিন্তু তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না কোন বৈষ্ণব কবির রচনায়। অতএব সঙ্গত কারণেই এই মতটিকে বৈষ্ণব আচার্য্যরা মেনে নেননি।"

সুজয় বলে, "কিন্তু আমি শুনেছিলাম মহাত্মা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বলেছেন যে মহাপ্রভু দেহত্যাগের পূর্বে তোটা গোপীনাথের মধ্যে শক্তিসঞ্চার করে দিয়ে তাঁর মধ্যেই প্রবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন এবং মহাপ্রভুর তোটা গোপীনাথের মধ্যে প্রবেশ করার পর থেকে তোটা গোপীনাথের উরুতে একটি সুবর্ণচিহ্নও দেখা যায়। সে প্রসঙ্গে কি বলবে?"

আমি বলি, "দ্যাখো, গোস্বামীপ্রভু কিন্তু ছিলেন মহাপ্রভুরই নব কলেবরস্বরূপ। তাই তাঁর মত অবশ্যই শ্রদ্ধার সাথে বিচার করা উচিত। কিন্তু মহাত্মাদের সকল কথার ব্যাখ্যা তো অত সহজে করা যায় না। তাঁদের বক্তব্যে সরল অর্থের চেয়ে নিহিতার্থ যে বেশী প্রাধান্য পায়। তাই তাঁর কথার ব্যাখ্যা আরেক ভাবেও করা যায়। শ্রীকৃষ্ণের প্রেমাবতার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু উপলব্ধি করেছিলেন যে তাঁর লীলাশেষের কাল সমাগত। হয়তো তাই দেহরক্ষা করার আগে নিজের সকল শক্তি সঞ্চার করে দিয়েছিলেন তোটা গোপীনাথের মধ্যে। কারণ তাঁর অপ্রাকৃত শক্তি ধারণ করার ক্ষমতা অন্য মানুষের ছিল না। তোটা গোপীনাথের উরুর ওই সুবর্ণচিহ্ন নির্ঘাৎ সেই শক্তি সঞ্চারেরই প্রমাণ। গোস্বামীপ্রভু তোটা গোপীনাথের মধ্যে প্রবিষ্ট হওয়ার কথাও বলেছেন। আর আমি শুনেছি তোটা গোপীনাথের ঠিক নীচ দিয়ে একটি সুড়ঙ্গ ছিল সাগর অবধি যা পরবর্তীকালে বুজিয়ে দেয়া হয়। এমনও তো হতে পারে যে মহাপ্রভু সেই সুড়ঙ্গপথেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন তোটা গোপীনাথের মধ্যে শক্তি সঞ্চার করার পর। তাই কেউ আর তাঁকে তোটা গোপীনাথ থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেননি। মনে করে দ্যাখো দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণও সকল কর্ম শেষ করে নিয়তিকে বরণ করে নেয়ার জন্য শান্তভাবে জরা ব্যাধের জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন প্রভাসের অরণ্যে। ঠিক তেমনিভাবেই হয়তো মহাপ্রভুও তাঁর সকল শক্তি তোটা গোপীনাথের মধ্যে সঞ্চার করে দিয়ে নিজের ভবিতব্যকে বরণ করতে চলে গেছেন জগন্নাথ মন্দিরে।"

মধুপর্ণা জিজ্ঞাসা করে, "তাহলে কি জগন্নাথ মন্দিরেই তিনি দেহরক্ষা করেছিলেন?"

আমি বলি, "জাগতিক দৃষ্টিতে দেখলে তেমনটাই তো ইঙ্গিত করছে অন্য সকল সূত্র।” 

সুজয় বলে, "কিভাবে?”

আমি বলি, "এ প্রসঙ্গেও অনেকগুলি মত আমরা পাই। প্রথমেই বলি শ্রীচৈতন্যদেবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ওড়িয়া শিষ্য অচ্যুতানন্দের কথা। তিনি তাঁর 'শূন্যসংহিতা' গ্রন্থে লিখেছেন

'চৈতন্যঠাকুর মহানৃত্যকার রাধা রাধা ধ্বনি কলে।     জগন্নাথ মহাপ্রভু শ্রীঅঙ্গে বিদ্যুন্ প্রায় মিশি গলে।।' 

অর্থাৎ- তিনি জগন্নাথ মন্দিরে 'রাধা রাধা' ধ্বনি দিতে দিতে বিদ্যুতের মত অন্তর্হিত হয়ে যান শ্রীঅঙ্গে।

 বিশিষ্ট ভক্ত কবি ঈশান নাগর আবার তাঁর 'অদ্বৈতপ্রকাশ' গ্রন্থে লিখেছেন

'একদিন গোরা জগন্নাথে নিরখিয়া।
 শ্রীমন্দিরে প্রবেশিল 'হা নাথ' বলিয়া।। 
প্রবেশমাত্রে দ্বার স্বয়ং রুদ্ধ হৈল। 
ভক্তগণ মনে বহু আশংকা জন্মিল।।
 কিছুকাল পরে স্বয়ং কপাট খুলিল।
  গৌরাঙ্গাপ্রকট সবে অনুমান কৈল।।' 
অর্থাৎ- সেদিন মহাপ্রভু জগন্নাথ দর্শনের জন্য মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করামাত্র মন্দিরের দ্বার বন্ধ হয়ে যায়। ভক্তরা নানা আশংকা করতে থাকেন। মন্দিরের দ্বার যখন পুনরায় খুলল তখন দেখা গেল শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অপ্রকট হয়েছেন। এই ব্যাখ্যাটি কিন্তু বেশ যুক্তিযুক্ত।

'জগন্নাথ চরিতামৃত' কাব্যে দিবাকর দাসও লিখেছেন যে মহাপ্রভু সবার অলক্ষ্যে 'শ্রীজগন্নাথ অঙ্গে লীন' হয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন যে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যে উৎস থেকে ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন অন্তিমে সেই জগন্নাথদেবের মধ্যেই ফিরে গিয়েছেন। 

এ প্রসঙ্গে 'শ্রীচৈতন্যভাগবত' গ্রন্থে ঈশ্বরদাস লিখছেন ভাবাবিষ্ট শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জগন্নাথদেবকে চন্দন পরানোর সময়ে প্রীত হয়ে জগন্নাথদেব মুখ বিস্তৃত করেন। তৎক্ষণাৎ মহাপ্রভুর হাত থেকে চন্দনপাত্র পড়ে যায় এবং তিনি জগন্নাথদেবের বিস্তৃত মুখগহ্বরে প্রবেশ করে লীন হয়ে যান বিগ্রহগর্ভে। এই মতটি অবশ্য বিশেষ বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। তাই পরবর্তীকালে মহাপ্রভুর সন্ন্যাসী পার্ষদ বাসুদেব তীর্থ এ বিষয়ে ঈশ্বরদাসকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন; জানতে চেয়েছিলেন যে কেন তিনি এমনধারা কথা লিখেছেন। উত্তরে ঈশ্বরদাস বলেছিলেন যে তিনি যা লিখেছেন তা তাঁর গুরুর আদেশেই লিখেছেন। তিনি আরো বলেছিলেন যে এক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্যের আক্ষরিক অর্থের পরিবর্তে তাত্ত্বিক অর্থটিই ধরতে হবে। সেই তাত্ত্বিক অর্থটা বুঝতে ভুল হওয়ার নয় -ভাবাবিষ্ট শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জগন্নাথদেবের মধ্যে লীন হয়ে গেছেন।

অতঃপর আসি বৈষ্ণবদাসের বক্তব্যে। তিনি তাঁর 'চৈতন্য চকড়া' গ্রন্থে লিখেছেন যে পূর্ণিমা তিথিতে জগন্নাথ মন্দিরে মহাপ্রভুর দেহপাত হয় 
 'রাত্র দশ দণ্ডে চন্দন বিজয় যখন হল।।
  তখন পড়িলা প্রভুর অঙ্গ স্তম্ভ পছ আড়ে।
  কান্দিল বৈষ্ণবগণ কুহাতো কুহাড়ে।।'

অর্থাৎ আষাঢ়মাসের পূর্ণিমার রাতে জগন্নাথ মন্দিরে যখন জগন্নাথদেবের চন্দন সেবন হচ্ছিল তখনই গরুড়স্তম্ভের পিছনে ভাবাবিষ্ট অবস্থায় শ্রীচৈতন্যদেবের দেহ পড়ে যায়। অতএব আমরা দেখতে পাচ্ছি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জগন্নাথ অঙ্গে লীন হওয়ার
ব্যাখ্যাটিই সবাই গ্রহণ করছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল- এই জগন্নাথ অঙ্গে লীন হওয়াটা কি কোন সূত্র? অধিকাংশ ভক্তই তো এদিকেই নির্দেশ করছেন। তার অর্থ এমনো হতে পারে যে তখন বৈষ্ণব আচার্য্যরা যে বক্তব্য সরাসরি বলে যেতে পারেননি তা পরবর্তীকালের গবেষকদের সুবিধার জন্য হয়তো সাংকেতিকভাবে বলে গেছেন এই বাক্যের মাধ্যমে। কারণ সকলেই মানেন যে অবতার যখন লৌকিক দেহ ধারণ করে ধরায় অবতীর্ণ হন তখন লৌকিক উপায়েই তাঁরা এই নশ্বর দেহ ত্যাগ করেন। তাহলে প্রেমাবতার শ্রীচৈতন্যদেব জগন্নাথদেবের মধ্যে লীন হয়ে গেলেও তাঁর স্থূলদেহটি পাওয়া গেল না কেন? তবে কি স্থূলদেহটির এমন কোন অমর্য্যাদা করা হয়েছিল যা ভক্তসমক্ষে এলে পুরীতে জ্বলে যেত বিদ্রোহের আগুন? এর থেকে তো একটাই উপসংহারে আসা যায়- শ্রীচৈতন্যদেবের স্বাভাবিক দেহরক্ষা হয়নি। আর মহাপ্রভুকে যদি আদৌ হত্যা করা হয়ে থাকে তবে সেটির জন্য জগন্নাথ মন্দিরই যে আদর্শ স্থান সেটিও বলাই বাহুল্য। কারণ এই মন্দিরে এমন কিছু রন্ধ্র আছে যেখানে কাউকে যদি সমাধি দেয়া হয় তবে তাঁর মরদেহ কোনদিন খুঁজে বের করা সম্ভব হবে না। আর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যদি সজ্ঞানেই নিজেকে জগন্নাথদেবের বিগ্রহের মধ্যে লীন করে দিতে চেয়ে থাকেন তাহলেও গুণ্ডিচা বাড়ি বা তোটা গোপীনাথের পরিবর্তে জগন্নাথ মন্দিরেরই বেশী প্রাধান্য পাওয়ার কথা। কারণ মহাপ্রভু যে জগন্নাথ অন্তপ্রাণ ছিলেন সেটা একবাক্যে সকলেই স্বীকার করবেন। অতএব আমরা ধরে নিতে পারি যে মহাপ্রভুর রহস্যমণ্ডিত দেহত্যাগের ক্ষেত্র ছিল জগন্নাথ মন্দির। এমনও হতে পারে যে মহাপ্রভু তোটা গোপীনাথের মাঝে আপন শক্তিসঞ্চার করে দিয়ে সুড়ঙ্গপথে সেখান থেকে বেরিয়ে জগন্নাথ মন্দিরেই চলে এসেছিলেন তাঁর স্থূলদেহের শেষ পরিণতিকে নির্ভয়ে বরণ করে নিতে। যাঁর স্পর্শে কত অসুস্থ হয়ে উঠেছে সুস্থ, যাঁর ডাকে শ্রীবাস পণ্ডিতের মৃত সন্তানের আত্মা পরলোক থেকে ফিরে এসে বাবা-মাকে সান্ত্বনা দিয়ে গেছে তাঁর পক্ষে আপন ভবিতব্য সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়া তো খুবই স্বাভাবিক। তাই নিশ্চয়ই সজ্ঞানে সব জেনেশুনেই তোটা গোপীনাথের মধ্যে নিজের সমস্ত শক্তি সঞ্চার করে দিয়ে মহাপ্রভু ফিরে এসেছিলেন জগন্নাথ মন্দিরে নিজের স্থূলদেহের শেষ মুহুর্তটিকে বরণ করে নিতে।"

সুজয় বলে, "তুমি তো ওড়িয়া কবি গোবিন্দের মতটিকে ধরলেই না। তিনি লিখেছিলেন যে মহাপ্রভু ফাল্গুনের শুক্লা একাদশী তিথিতে বৈকুন্ঠে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেইমত সমুদ্রতীরের একটি কুটিরে তিনি সমাধিমগ্ন হন। পাঁচদিন সমাধিতে থাকার পর সন্ধ্যাবেলায় সমাধি থেকে উঠে তিনি সবাইকে ডাক দেন। তারপর শুরু করেন হরিনাম। গোবিন্দ
বলছেন যে সেই নাম করতে করতেই সহসা তিনি বিদ্যুতের মত অন্তর্হিত হয়ে যান।" 

আমি বলি, "গোবিন্দের মতটা না ধরার কারণ এই ব্যাখ্যাটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। যদি সত্যিই তেমনটি হত তাহলে নিশ্চয়ই সমুদ্রতীরে আজ আমরা মহাপ্রভুর সমাধিমন্দির দেখতে পেতাম। মহাপ্রভু তাঁর ভক্ত হরিদাস ঠাকুরকে সমুদ্রতীরে সমাধি দেয়ায় সেখানে মঠ তৈরী হয়ে গেল আর স্বয়ং মহাপ্রভু যেখানে অন্তর্দ্ধান করলেন সেখানে কোন স্মৃতিচিহ্নই রইল না এতো নিতান্তই অবাস্তব ব্যাপার। এজন্যই বৈষ্ণব ভক্তরা এই মতটিকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন।"

মধুপর্ণা বলে, "তাহলে দ্যাখো মহাপ্রভুর অন্তর্দ্ধানের ক্ষেত্র সম্বন্ধে বৈষ্ণবদাস, অচ্যুতানন্দ, দিবাকরদাস, ঈশ্বরদাস ও ঈশান নাগর বলছেন জগন্নাথ মন্দির। লোচনদাস বলছেন গুণ্ডিচা বাড়ি। আবার জয়ানন্দ, নরহরি চক্রবর্তি ও সদানন্দ কবিসূর্য্য ব্রহ্ম বলছেন তোটা গোপীনাথের মন্দির এবং গোবিন্দ বলছেন সমুদ্রতীরের কুটির। অন্যদিকে অন্তর্দ্ধানের সময় প্রসঙ্গেও দেখা যাচ্ছে নানা মত। ঈশ্বরদাস বলছেন বৈশাখের শুক্লা তৃতীয়া, জয়ানন্দ বলছেন আষাঢ় মাসের শুক্লা সপ্তমীর রাত দশটা, লোচনদাস বলছেন আষাঢ় মাসের শুক্লা সপ্তমীর বেলা তিন প্রহর, গোবিন্দ বলছেন ফাল্গুনের পূর্ণিমা এবং বৈষ্ণবদাস বলছেন আষাঢ়ের পূর্ণিমা। কিন্তু প্রশ্ন হল - মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্দ্ধান প্রসঙ্গে এত মত আসছে কেন?"

আমি বলি, "কারণটা সহজেই অনুমেয়। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর দেহরক্ষার পর পুরীধামে একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। তাই দীর্ঘদিন এ ব্যাপারে কেউ মুখ খোলার সাহস পাননি। ফলে সময়ের সাথে সাথে ঘটনাটি নানাজন নানাভাবে পরিবেশন করেছেন জনমানসে। তারই ফলে এমন গোলমাল হয়েছে দিন-তিথির হিসেবে।"

সুজয় জিজ্ঞাসা করে, "তাহলে তোমার কি মত - কোথায় এবং কখন মহাপ্রভুরদেহরক্ষা হয়েছে?" 

আমি বলি, "আমার মগজাস্ত্র প্রয়োগ করলে স্থান হিসেবে তো জগন্নাথ মন্দিরের নামটাই মনে হয়। আর যেহেতু বৈষ্ণবদাসের বিবরণটা যুক্তিযুক্ত তাই আষাঢ়ের পূর্ণিমাকেই বেছে নেব তাঁর তিরোধানের কাল হিসেবে। সেইসাথে তাঁর 'জগন্নাথ অঙ্গে লীন' হওয়া যে কোন রহস্যের দিকে ইঙ্গিত করছে (সে রহস্য জাগতিক হোক বা মহাজাগতিক) তাতো উপরের বিবরণগুলি থেকেই বোঝা যায়।"

-"কি সেই রহস্য?”

-"অস্বাভাবিকভাবে মহাপ্রভুর অন্তর্দ্ধান।"

মধুপর্ণা বলে, "এই অন্তর্দ্ধানের নেপথ্যে কাদের হাত থাকতে পারে?"

আমি বলি, "এ প্রসঙ্গে প্রথমে জাগতিক দিক থেকেই রহস্যটিকে বিশ্লেষণ করা যাক। আর এই জাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হলে ইতিহাসেরই শরণ নেয়া বাঞ্ছনীয়। আমাদের দেখতে হবে সেসময়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বিরোধী কারা ছিলেন? এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলি - এতক্ষণ যাঁদের মতের কথা বিশ্লেষণ করলাম তার মধ্যে কারোর মতে শুনেছ কি যে পাণ্ডাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে?"

-"নাঃ। কিন্তু মন্দিরে মহাপ্রভুর অন্তর্দ্ধান হলে সে সম্বন্ধে পাণ্ডাদেরই তো জানার
কথা।"
  .........................

গ্রন্থ - মহাপ্রভুর নীলাচলে আজো চলে লীলা
 লেখক - তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
 গ্রন্থ মূল্য - ১২০/-
  পৃষ্ঠা -২৪০।
  প্রকাশনা - জয় মা তারা পাবলিশার্স।

 সম্পূর্ণ বইটি 20 % ছাড়ে কিনে পড়তে যোগাযোগ করতে পারেন -

   আমাদের প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত সাধক লেখক তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের এই বইয়ের অনলাইন প্রাপ্তিস্থান - আমাদের জয় মা তারা পাবলিশার্সএর ফেসবুক পেজ -
  https://www.facebook.com/JayMaTaraPublisher?mibextid=ZbWKwL

   সাথে হোয়াটস আপ করে অর্ডার দিতে পারেন এই নম্বরে। থাকছে বিশেষ ডিসকাউন্ট ।
  9153391909।

কলেজস্ট্রিট থেকে যারা হাতে হাতে বই নিতে চান তাঁরা যেতে পারেন -

  ১) মহেশ লাইব্রেরি (9123923531)
 
  ২) দে বুক স্টোর (দীপুবাবু) - (9143549970)

বইটি boichitro.in থেকে  কেনার লিংক -
  https://boichitro.in/product/mahaprabhur-nilachole-ajo-chole-lila-%E0%A6%AE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AD%E0%A7%81%E0%A6%B0-%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A6%B2%E0%A7%87-%E0%A6%86/

বইটির ebook ডাউনলোড করার লিংক -

https://play.google.com/store/books/details/Tarashis_Gangopadhyay_%E0%A6%AE%E0%A6%B9_%E0%A6%AA_%E0%A6%B0%E0%A6%AD_%E0%A6%B0_%E0%A6%A8_%E0%A6%B2_%E0%A6%9A%E0%A6%B2_%E0%A6%86%E0%A6%9C_%E0%A6%9A%E0%A6%B2_%E0%A6%B2_%E0%A6%B2?id=M2o9EAAAQBAJ

#booklover 
#books
#booknow
#ভক্ত
#জয়_মা_তারা_পবলিশার্স
#spiritualgrowth
#spirituality
#spiritualjourney
#spiritualbooks
#devotionalbook
#devotion
#devotional
#virals
#viralpost
#publisherstory
#publishing
#combo
#offers
#readers
#readerscommunity
#grow
#soul
#development
#journey
#jaymatarapublishers

Saturday 6 April 2024

ভক্তি বড় না জ্ঞান বড়? বলছেন তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়

প্রশ্ন :- আচ্ছা, প্রায়ই শুনতে পাই যে অনেকেই বলেন ভক্তি বড়। তাহলে জ্ঞান কি কোন কাজের কিছু নয়?

তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় : জ্ঞান ও ভক্তি দুই-ই হল ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনোর দুটি মূল পথ। আর দুটিই সার্থক হয় যখন তা কর্মের সাথে যুক্ত হয়। আর সে কর্ম শুধু মৌখিক কর্ম হলে চলবে না। তাকে থিওরির ক্ষেত্র ছেড়ে practical এর সঙ্গে মিশতে হবে। জ্ঞান বল বা ভক্তি বল তা তখনই যথাযথ হবে।
   এমনিতে এটা সত্যি যে জ্ঞানের পথের লোক বলেন - ভক্তি বস্তুটা আদৌ কোন কাজের কিছু নয়। আবার ভক্তির পথের মানুষরাও অনেকেই মনে করেন যে জ্ঞান ক্ষতিকারক ভক্তির পক্ষে। তাঁরা কারণ হিসেবে বলেন যে মহাপ্রভু বলে গেছেন জ্ঞান নয় ভক্তি শ্রেষ্ঠ।কিন্তু আজকের যুগে দাঁড়িয়ে আমাদের বুঝতে হবে - নিজে জ্ঞানের চূড়ায় পৌঁছেও কেন বলেছেন তিনি এ কথা?
  এর উত্তর একটাই - তিনি আলোর দিশা উন্মুক্ত করে দিয়েছেন সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্যে। কলিযুগে সাধারণ মানুষের জ্ঞানের পথে যাওয়ার মত ব্যক্তিত্ব,সহ্যশক্তি ,ধৈর্য কিছুই নেই। তাই তিনি বুঝেছিলেন যে এদের জ্ঞানের পথে পাঠালে কিছুই পারবে না। বরং ভক্তির পথে গিয়ে যদি শুধু ঠাকুরের শ্রীচরণ স্মরণ করে তাঁর শরণ নিয়ে থাকে তবে ঠাকুর নিজেই এসে উৎরে দেবেন। ভক্তি হল নির্ভরতার সাধনা আর জ্ঞান হল পুরুষকারের সাধনা।আমাদের আজকের যুগে পুরুষকার আছে কি? যা আছে শুধুই অপরের উপর নির্ভরতা। তাই মহাপ্রভূ দেখলেন - সামাজিক জীব যদি এই পরনির্ভরতার ভাবটা মানুষের পরিবর্তে ঈশ্বরের উপরে রাখতে পারে তবে তো ঠাকুর নিজে নেমে এসে কোলে তুলে নেবেন। তাই তিনি জ্ঞানের পরিবর্তে সাধারণের জন্যে ভক্তির পথ দেখালেন। কিন্তু তাই বলে জ্ঞান ফেলনা নয়। এই পথে চলার জণ্যে অনেক কষ্ট করতে হয়। শঙ্করাচার্য, মধ্যাচার্য, রমণ মহর্ষি বা স্বামী বিবেকানন্দ কিন্তু এমনি এমনি হওয়া যায় না। অনেক সাধনার প্রয়োজন হয়। তাই কথায় কথায় জ্ঞানকে ছোট করা মুর্খতার সামিল।
    আর মজার কথা কি জানো - যে জ্ঞান ও ভক্তির মধ্যে একটি পথের শেষ ঠিকানায় পৌঁছতে পারে তার মধ্যে অপরটিও ঠাকুরের কৃপায় আপনা থেকেই জেগে যায়। সত্যিকারের জ্ঞানী তখন হয়ে ওঠেন বড় ভক্ত। আর সত্যিকারের ভক্ত হয়ে ওঠেন ত্রিকালজ্ঞ জ্ঞানী। কারণ দুটি পথ ভিন্ন মতের হলেও অন্তিমে যে সবই মিলেমিশে হয় জয় একাকার।
   ভালো থেকো। জয় গোপাল।

Thursday 4 April 2024

গ্রন্থ - ক্ষণিক খোঁজে চিরন্তন (তিন খণ্ডে সমাপ্ত) লেখক - তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়। প্রকাশনা ও মূল প্রাপ্তিস্থান - জয় মা তারা পাবলিশার্স



 একটা অসাধারণ সেট। তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্ল্যাসিক সৃষ্টি।

   গ্রন্থ - ক্ষণিক খোঁজে চিরন্তন
(তিন খণ্ডে সমাপ্ত)

    লেখক - তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়।
    প্রকাশনা ও মূল প্রাপ্তিস্থান -
 জয় মা তারা পাবলিশার্স ফেসবুক পেজ।
https://www.facebook.com/JayMaTaraPublisher?mibextid=ZbWKwL

সরাসরি হোয়াটস আপ করে জয় মা তারা পাবলিশার্স-এ অর্ডার দিতে পারেন এই নম্বরে। পুরো সেটের জন্যে থাকছে বিশেষ 25% ডিসকাউন্ট।
 ডায়াল - 9153391909।

  বইটির তিন খন্ড।
  ১) প্রথম খন্ড -  মধ্যপ্রদেশ পর্ব (মূল্য ৮০/-) 
  (মধ্যপ্রদেশ পর্ব—ইচ্ছামৃত্যুসম্পন্ন মহাযোগী রুদ্রানন্দজীর সান্নিধ্যে নর্মদাতীর্থ মধ্যপ্রদেশের
সকল মহাতীর্থে ও বিশিষ্ট পর্যটন কেন্দ্রে মুসাফির লেখকের ভ্রমণের রোমাঞ্চকর বিবরণ
এবং সেইসাথে রুদ্রানন্দজীর জীবন থেকে মহাজীবনের উত্তরণের অপার্থিব অভিজ্ঞতার
অপূর্ব বিবরণ)।

   এই বইটির প্রথম খন্ডের e book google playbook এ বিশেষ ডিসকাউন্টে  পেয়ে যাবেন -
 https://play.google.com/store/books/details/Tarashis_Gangopadhyay_%E0%A6%95_%E0%A6%B7%E0%A6%A3_%E0%A6%95_%E0%A6%96_%E0%A6%9C_%E0%A6%9A_%E0%A6%B0%E0%A6%A8_%E0%A6%A4%E0%A6%A8_%E0%A6%AE%E0%A6%A7_%E0%A6%AF%E0%A6%AA_%E0%A6%B0%E0%A6%A6?id=jAtBEAAAQBAJ

এই খণ্ডটির হার্ড কপি অনলাইনে পাওয়া যাবে এইখানে -

১)Dey Book Store Online -
https://www.deybookstoreonline.com/product/khonik-khoje-chirantan-2/

২) Boichitro.in -
  
https://boichitro.in/product/khonik-khoje-chittaranjan-madha-pradesh-parba 

২) দ্বিতীয় খন্ড - নাসিক শিরডি-দ্বারকা-প্রভাস পর্ব (মূল্য ৯০/-) 
  ( বিষয় বস্তু - নাসিক শিরডি-দ্বারকা-প্রভাস পর্ব—লেখকের একান্তে নাসিক-ত্রম্বকেশর-শিরডি-শনি শিঙ্গনাপুর ভ্রমণ আর ইচ্ছামৃত্যুসম্পন্ন মহাযোগী রুদ্রানন্দজীর সান্নিধ্যে দ্বারকা-বেট দ্বারকা-হরসিদ্ধি-প্রভাস-সোমনাথের মত মহাতীর্থ দর্শনের রোমাঞ্চকর বিবরণ)। 

বইটির দ্বিতীয় খন্ডের ebook google playbook এ বিশেষ ডিসকাউন্টে  পেয়ে যাবেন -

https://play.google.com/store/books/details/Tarashis_Gangopadhyay_%E0%A6%95_%E0%A6%B7%E0%A6%A3_%E0%A6%95_%E0%A6%96_%E0%A6%9C_%E0%A6%9A_%E0%A6%B0%E0%A6%A8_%E0%A6%A4%E0%A6%A8_%E0%A6%A8_%E0%A6%B8_%E0%A6%95_%E0%A6%B6_%E0%A6%B0?id=iiRBEAAAQBAJ

এই খণ্ডটির হার্ড কপি অনলাইনে পাওয়া যাবে এইখানে -
১)Dey Book Store  -
  https://www.deybookstoreonline.com/product/khonik-khoje-chirantan/

২) Boichitro.in -
   https://boichitro.in/product/khonik-khoje-chirantan-nashik-sirdi-dwarka-probhas-parba/
  

৩) তৃতীয় খন্ড - দক্ষিণ ভারত পর্ব (মূল্য ১২০/- ) 
  (দক্ষিণ ভারত পর্ব—ইচ্ছামৃত্যুসম্পন্ন মহাযোগী রুদ্রানন্দজীর সঙ্গে লেখকের চেন্নাই, তিরুপতি, পণ্ডিচেরী, মহাবলীপুরম,পক্ষীতীর্থ,শিবকাঞ্চী, বিষ্ণুকাঞ্চী,শ্রীরঙ্গম, পুত্তাপূর্তি, গুরুবায়ুর,মাদুরাই,রামেশ্বর, পদ্মনাভতীর্থ ত্রিভান্দ্রম,শুচীন্দ্রম,কন্যাকুমারীর মত মহাতীর্থ দর্শনের রোমাঞ্চকর বিবরণ, রুদ্রানন্দজীর অতীতে সবরীমালা দর্শনকালীন মহাসিদ্ধিলাভের অভিজ্ঞতার অপূর্ব বিবরণ এবং সেইসাথে আগে থেকে বলে রাখা নির্দিষ্ট সময়ে ভক্তদের সৎসঙ্গে যোগসিদ্ধির পথ বলে দিয়ে রুদ্রানন্দজীর যোগবলে সজ্ঞানে মহাসমাধি গ্রহণের অপার্থিব অপূর্ব বিবরণ)।

বইটির তৃতীয় খন্ডের ebook google playbook এ বিশেষ ডিসকাউন্টে  পেয়ে যাবেন -
https://play.google.com/store/books/details/Tarashis_Gangopadhyay_%E0%A6%95_%E0%A6%B7%E0%A6%A3_%E0%A6%95_%E0%A6%96_%E0%A6%9C_%E0%A6%9A_%E0%A6%B0%E0%A6%A8_%E0%A6%A4%E0%A6%A8_%E0%A6%A6%E0%A6%95_%E0%A6%B7_%E0%A6%A3_%E0%A6%AD?id=4CRBEAAAQBAJ

এই খণ্ডটির হার্ড কপি অনলাইনে পাওয়া যাবে এইখানে -
 ১) Dey Book Store Online- 
 https://www.deybookstoreonline.com/product/khonik-khoje-chirantan-dakhkhinbharat-parbo/

২) Boichitro.in -
  https://boichitro.in/product/khonik-khoje-chirantan-dakshin-bharat-parba/

হাতে হাতে বই নিতে কলেজস্ট্রিট-এ আসতে পারেন -

১) মহেশ লাইব্রেরী  - (9123923531)
২) দে বুক স্টোর (দীপুদা) :- (9143549970)

Saturday 30 March 2024

পূজা বলতে আমরা মানুষরা কি বুঝি? বলছেন তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়।

প্রশ্ন - পূজা বলতে আমরা মানুষরা কি বুঝি? ইষ্ট বা গুরুর সামনে মাথা নোয়ানোকে কি পূজা বলে?

  তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় - ইষ্ট বা গুরুর সামনে মাথা নোয়ানো, তাঁদের পায়ে ফুল দেয়া, যজ্ঞে সমিধ দিয়ে তাঁদের নাম উচ্চারণ করা, তাঁদের সামনে মন্ত্র পাঠ ও তাঁদের স্তুতি করা - একে সাধারণ মানুষ পূজা বলে জানে। অনেকে আবার পূজা করতে করতে চোখের জলে ভাসে। কিন্তু এটা হল আবেগ। এটা আদৌ পূজা নয়। 
    পূজা হল শ্রদ্ধা ও ভক্তির মিশ্রণে সৃষ্টি এমন একটি ভাব যা কারোর মনে আপনা থেকে না জাগলে করা সম্ভব নয়। আর জাগলে না করে থাকাও সম্ভব নয়। পূজা হল অন্তরের শুভ বিচারের নাম, পূজা হল ভালো কর্মের নাম, পূজা হল অকাতরে জীবসেবার অন্য নাম - শুধু নিজের জন্যে না বেঁচে জগতের মঙ্গলের জন্যে বাঁচার নাম হল পূজা। আর সব থেকে বড় কথা হল - এসবের মাধ্যমে অপরকে না দেখিয়ে নিজের মনের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ইষ্ট গুরুকে সঙ্গোপনে জানানোই হল যথার্থ পূজা। এই পূজাই হল শ্রেষ্ঠ পূজা যা স্বয়ং ঈশ্বর সানন্দে গ্রহণ করেন। কিন্তু কত জন এই পূজা করেন সেটাই হল প্রশ্ন।
   #আধ্যাত্মিক #spiritual #banglareels  #tarashisgangopadhyay #tarashisauthor 

Sunday 24 March 2024

সাধক লেখক তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের সকল বইয়ের তালিকা ও অনলাইন প্রাপ্তিস্থান

জয়  মা তারা পাবলিশার্স প্রকাশিত সাধক লেখক তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের সব বইয়ের অনলাইন প্রাপ্তিস্থান - আমাদের জয় মা তারা পাবলিশার্সএর ফেসবুক পেজ -
  https://www.facebook.com/JayMaTaraPublisher?mibextid=ZbWKwL
   হোয়াটস আপ করে অর্ডার দিতে পারেন এই নম্বরে -
  9153391909।

কলেজস্ট্রিট থেকে যারা হাতে হাতে বই নিতে চান তাঁরা যেতে পারেন -

  ১) মহেশ লাইব্রেরি (9123923531)
 
  ২) দে বুক স্টোর (দীপুবাবু) - (9143549970) (এখানে হাতে হাতে প্রতি বইতে 20% ছাড় দেয়া হয়)
https://www.deybookstoreonline.com

  জয় মা তারা পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত সমস্ত বইয়ের তালিকা এখানে দেয়া হল -

* মহাসিন্ধুর ওপার থেকে (মূল্য ৮০/-)
(দেহ থেকে দেহাতীতে গিয়ে এক সিদ্ধ ক্রিয়াযোগীর পরলোকের বিভিন্ন স্তরদর্শন ও দিব্যদেহধারী মহাত্মাদের সাথে কথোপকথনের এক চমকপ্রদ সত্যনিষ্ঠ বিবরণ)

 * দেবলোকের অমৃত সন্ধানে
১। যমুনোত্রী গঙ্গোত্রী-গোমুখ পর্ব (মূল্য ১০০/-)
২। বাসুকীতাল-কালিন্দী খাল-বদ্রীনাথ পর্ব (মূল্য ১০০/-) 
৩। পঞ্চবদ্রী-পঞ্চপ্রয়াগ-পঞ্চকেদার পর্ব (মূল্য ১২০/- )
৪। নেপাল পর্ব (মূল্য ১০০/-)

(বাংলার ভ্রমণসাহিত্যের এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। ঐশীলীলার পরম পীঠস্থান গাড়োয়াল হিমালয়ের ও নেপাল হিমালয়ের পথে পথে লেখকের জাগতিক তথা মহাজাগতিক অভিজ্ঞতার রসসিক্ত বিবরণ। সেইসাথে গাড়োয়াল ও নেপাল হিমালয়ের প্রতিটি তীর্থের ঐতিহাসিক ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটের পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য পরিবেশনের মধ্য দিয়ে হিমালয়ের আধ্যাত্মিক তথা জাগতিক সৌন্দর্য্যের রূপ সার্থকভাবে তুলে ধরা হয়েছে এই গ্রন্থে ভ্রমণকাহিনীর আঙ্গিকে)

* অতীন্দ্রিয় জগতের আহ্বান (দুই খণ্ডে সমাপ্ত – ১ম খণ্ড ৭০/-, ২য় খণ্ড
৭০/-)
(লেখক ও তাঁর পরিচিত প্রিয়জনদের জীবনে অতীন্দ্রিয় জগতের আত্মাদের আগমন এবং তাদের মৃত্যুর পরের অভিজ্ঞতা তথা মরণের পরবর্তী অবস্থান সম্বন্ধে জানানো সবিশদ তথ্যসম্বলিত একগুচ্ছ চাঞ্চল্যকর সত্যঘটনার রোমাঞ্চকর বিবরণ)

* বৃন্দাবনে আজো ঘটে অঘটন (মূল্য ৭০/-)
(শ্রীধাম বৃন্দাবনে এক বৈজ্ঞানিক মনোভাবাপন্না যুক্তিবাদিনী নারীর গোপালের অপার কৃপায় সিদ্ধ গোপালসাধিকায় রূপান্তরিত হওয়ার অপার্থিব অভিজ্ঞতার অভূতপূর্ব বিবরণ তথা বৃন্দাবনে যে গোপাল-শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীরাধা আজো কত অঘটন নিত্য ঘটান তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সত্যনিষ্ঠ ও চিত্তাকর্ষক বিবরণ)

* জ্ঞানগঞ্জের অমৃতলোকে (মূল্য ৬০/-)
(গুরুদেবের সান্নিধ্যে এক মহাযোগীর হিমালয়ের ঈশ্বরকোটির যোগী মহাত্মাদের নিভৃত সাধনক্ষেত্র জ্ঞানগঞ্জ দর্শনের অনুপম অভিজ্ঞতার রোমাঞ্চকর সত্যনিষ্ঠ বিবরণ)

 * কাশীধামে আজো ঘটে অঘটন (মূল্য ৮০/-)
(কাশীধামে বাবা বিশ্বনাথ ও মা অন্নপূর্ণা কিভাবে আজো তাঁদের শরণাগত ভক্তকে সর্বতোভাবে রক্ষা করেন তারই এক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অপূর্ব নিদর্শন। সেইসাথে সমগ্র কাশীধামের 
প্রতিটি তীর্থের পৌরাণিক, আধ্যাত্মিক তথা ঐতিহাসিক বিবরণও সার্থকভাবে তুলে ধরা হয়েছে এই মহাগ্রন্থে)

 * শ্যামের মোহন বাঁশী (মূল্য ৬০/-)
(লেখকের আশ্রমের সদাজাগ্রত গোপালবিগ্রহ নানা অলৌকিক লীলার মধ্য দিয়ে কিভাবে তাঁকে যুগিয়েছেন মহাজীবনের আশ্বাস সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার রোমাঞ্চকর বিবরণ) 

*আজো লীলা করেন সাই (মূল্য ৫০/-)
(শিরডির সমাধি মন্দিরে সাইবাবার জীবনচরিত ও বিদেহলীলা আলোচনা করাকালীন এক রহস্যময় সাই সাধকের কাছে লেখকের শোনা সাইবাবার এক অনুপম বিদেহলীলা - কিভাবে শিরডির সাইবাবা আপন অলৌকিক শক্তিতে এক বালককে লোককল্যাণের জন্য সাধকে রূপান্তরিত করেন এবং উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে তাকে নিয়ে যান সিদ্ধির লক্ষ্যে সেই অপার্থিব অভিজ্ঞতার রোমাঞ্চকর বিবরণ)

* ক্ষণিক খোঁজে চিরন্তন
১) মধ্য প্রদেশ পর্ব (মূল্য ৮০/-) 
২) নাসিক-শিরডি-দ্বারকা-প্রভাস পর্ব (মূল্য ৯০/-) 
৩) দক্ষিণ ভারত পর্ব (মূল্য ১২০/-)
(মধ্যপ্রদেশ পর্ব — ইচ্ছামৃত্যুসম্পন্ন মহাযোগী রুদ্রানন্দজীর সান্নিধ্যে নর্মদাতীর্থ মধ্যপ্রদেশের সকল মহাতীর্থে ও বিশিষ্ট পর্যটন কেন্দ্রে মুসাফির লেখকের ভ্রমণের রোমাঞ্চকর বিবরণ এবং সেইসাথে রুদ্রানন্দজীর জীবন থেকে মহাজীবনের উত্তরণের অপার্থিব অভিজ্ঞতার অপূর্ব বিবরণ)

(নাসিক শিরডি-দ্বারকা-প্রভাস পর্ব-   লেখকের একান্তে নাসিক-ত্র্যম্বকেশ্বর-শিরডি-শনি শিঙ্গনাপুর ভ্রমণ আর ইচ্ছামৃত্যুসম্পন্ন মহাযোগী রুদ্রানন্দজীর সান্নিধ্যে দ্বারকা-বেট দ্বারকা-হরসিডি-প্রভাস-সোমনাথের মত মহাতীর্থ দর্শনের রোমাঞ্চকর বিবরণ)

(দক্ষিণ ভারত পর্ব—ইচ্ছামৃত্যুসম্পন্ন মহাযোগী রুদ্রানন্দজীর সঙ্গে লেখকের চেন্নাই, তিরুপতি, পণ্ডিচেরী, মহাবলীপুরম,পক্ষীতীর্থ,শিবকাঞ্চী, বিষ্ণুকাঞ্চী,শ্রীরঙ্গম,পুত্তাপুত্তি, গুরুবায়ুর,মাদুরাই,রামেশ্বর,পদ্মনাভতীর্থ ত্রিভান্দ্রম, শুচীন্দ্রম,কন্যাকুমারীর মত মহাতীর্থ দর্শনের রোমাঞ্চকর বিবরণ, রুদ্রানন্দজীর অতীতে সবরীমালা দর্শনকালীন মহাসিদ্ধিলাভের অভিজ্ঞতার অপূর্ব বিবরণ এবং সেইসাথে আগে থেকে বলে রাখা নির্দিষ্ট সময়ে ভক্তদের সৎসঙ্গে যোগসিদ্ধির পথ বলে দিয়ে রুদ্রানন্দজীর যোগবলে সজ্ঞানে মহাসমাধি গ্রহণের অপার্থিব অপূর্ব বিবরণ)

* From the world beyond death (Price-100/-) (A remarkable account of a yogi's visit to the higher dimensional world and his amazing experiences about after life gathered from the divine souls over there. This classic book,originally written by Tarashis Gangopadhyay has been translated by Saswati Das) 

* জন্মান্তর (মূল্য ৬০/- ) (বিশিষ্ট মহাসাধক স্বামী বিদ্যানন্দের সৌজন্যে একজন ব্রহ্মচারী সাধকের আজ্ঞাচক্র পথে জন্মান্তর যাত্রার অপার্থিব বিবরণ। বিগত সাত জন্ম ধরে তাঁর প্রারব্ধ ও ঋণানুবন্ধ কিভাবে তাঁকে নিয়ে এসেছে বর্তমান জন্মের আধ্যাত্মিক স্তরে তারই এক রোমাঞ্চকর বিবরণ এই গ্রন্থ)

* মহাপ্রভুর নীলাচলে আজো চলে লীলা (মূল্য ১২০/-) (লেখক কর্তৃক মহাপ্রভু জগন্নাথদেব ও সচল জগন্নাথ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নিত্যলীলার ক্ষেত্র পুরীধাম পরিক্রমা এবং সেইসাথে ভুবনেশ্বর, উদয়গিরি, খণ্ডগিরি, কোণারক, আলালনাথ ও নীলমাধব ভ্রমণের বিবরণ তথা সেখানকার সমস্ত তীর্থের ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক ও পৌরাণিক মাহাত্ম্যের প্রেক্ষাপটের বিশদ বর্ণনা এই গ্রন্থের সম্পদ। সেইসাথে পুরুষোত্তম জগন্নাথদেব এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যে আজো নীলাচলে নিত্য লীলা করেন তার কিছু বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার সত্যনিষ্ঠ বিবরণ)

 * অনন্তের জিজ্ঞাসা (পাঁচ খণ্ডে সমাপ্ত)
(মূল্য ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ, ৫ম ৬০/-) ১ম খণ্ড – সৎসঙ্গ পর্ব। ২য় খণ্ড—দশমহাবিদ্যাতত্ত্ব-রাধাকৃষ্ণতত্ত্ব-শিবতত্ত্ব-ব্রহ্মতত্ত্ব-গুরুতত্ত্ব পর্ব। ৩য় খণ্ড—যোগসাধন পর্ব। ৪র্থ খণ্ড— গীতা পর্ব। ৫ম খণ্ড – জীবন জিজ্ঞাসা পর্ব।(আধ্যাত্মিক জগতে অগ্রগতির জন্য ভক্ত শিষ্য-শিষ্যা ও পাঠক-পাঠিকাদের যে অসংখ্য সংশয়জড়িত আধ্যাত্মিক প্রশ্নের সবিশদ উত্তর দিয়েছেন সাধক লেখক তাঁর বিভিন্ন আধ্যাত্মিক অধিবেশনে সেসব উত্তরের এক অনুপম সংকলন এই গ্রন্থ যা সকলকে অধ্যাত্মপথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে চিরকাল)

* কেদারনাথে আজো ঘটে অঘটন (মূল্য ৬০/-)
(২০১৩ সালে হিমালয়ের মহাতীর্থ কেদারনাথে বিরাট প্রলয়ের দিনে মন্দিরের গর্ভগৃহের মধ্যে থেকেও কিভাবে লেখকের এক পাঠিকা অলৌকিকভাবে দেবাদিদেব কেদারনাথের অপার্থিব কৃপায় রক্ষালাভ করে ফিরে এসেছেন তার এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার অনবদ্য বিবরণ)

 * যেথা রামধনু ওঠে হেসে (মূল্য ৬০/- ) (লেখকের একগুচ্ছ ছোট গল্পের সংকলন)

* ভক্তের ভগবান (মূল্য ৭০/-) (এক সত্যনিষ্ঠ ভক্তের সাথে তাঁর প্রাণের ভগবানের অনুপম মাধুর্য্যমণ্ডিত লীলার অপার্থিব অভিজ্ঞতার অপূর্ব বিবরণ)

* আজো সেথা নিত্য লীলা করেন গোরা রায় ( মূল্য ৮০/-) (লেখক কর্তৃক মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের পদরেণুরঞ্জিত নিত্যলীলার ক্ষেত্র নবদ্বীপ পরিক্রমা  এবং সেইসাথে শাস্তিপুরসহ বাবলা, কালনা, গুপ্তিপাড়া, বাঘনাপাড়া এবং গোপালদাসপুর ভ্রমণের বিবরণ তথা সেখানকার সমস্ত তীর্থের আধ্যাত্মিক, ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক ও কিংবদন্তীর প্রেক্ষাপটের বিশদ বর্ণনা এই গ্রন্থের সম্পদ। সেইসাথে প্রেমাবতার শ্রীচৈতন্য
মহাপ্রভু যে আজো নিত্য লীলা করেন তার একাধিক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার অপূর্ব বিবরণ)

 * জীবন থেকে মহাজীবনের পথে। দুই খন্ড। ১ম খণ্ড (মূল্য ১২০/-) ২য় খন্ড (মূল্য ২০০/-)
(সাধক লেখক তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় কিভাবে অসংখ্য সাধক মহাত্মার আশীর্বাদে এবং গুরুকৃপায় সাধারণ জীবন থেকে সাধনার মহাজীবনের পথে এলেন এবং কিভাবে তাঁর ইষ্ট গোপালের অলৌকিক কৃপা তাঁকে চলার পথে যুগিয়েছে সাধনজীবনের পাথেয় তারই এক অনুপম বিবরণ লেখকের স্মৃতির পাতা থেকে) 

* সাংগ্রীলার গুপ্তযোগী (মূল্য ৬০/-)
(মহাযোগী রেচুং লামার সান্নিধ্যে এক গুপ্তযোগীর তিব্বতের উচ্চকোটির যোগী মহাত্মাদের নিভৃত সাধনক্ষেত্র সাংগ্রীলা দর্শনের এবং সেখানকার নিবিড় যোগসাধনার অনুপম অভিজ্ঞতার রোমাঞ্চকর সত্যনিষ্ঠ বিবরণ)

* ব্রজধামে আজো ঘটে অলৌকিক
১) বৃন্দাবন পর্ব (মূল্য ১৫০/-) 
২)মথুরা-রাধাকুণ্ড-গোবর্দ্ধন-কাম্যবন পর্ব (মূল্য ১৫০/-)
৩) বর্ষাণা-নন্দগ্রাম-গোকুল মহাবন পর্ব (মূল্য ১৫০/-)

 (শ্রীধাম বৃন্দাবন তথা ব্রজধাম পরিক্রমার পথে শ্রীরাধা আজো যে কত অঘটন নিত্য ঘটান তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সত্যনিষ্ঠ ও চিত্তাকর্ষক বিবরণ তথা বৃন্দাবন, মথুরা, মধুবন, তালবন, কুমুদবন, বহুলাবন, শান্তনুকুণ্ড, রাধাকুণ্ড, শ্যামকুণ্ড, গোবৰ্দ্ধন পর্বত, কাম্যবন, উচাগাঁও, বর্ষাণা, নন্দগ্রাম, খদিরবন, সংকেতবন, যাবট, কোকিলাবন, শেষশায়ী, ভদ্রবন, ভান্ডিররবন, বিল্ববন, লৌহবন, রাবেল ও গোকুল মহাবন পরিক্রমার পথে সমস্ত তীর্থের ঐতিহাসিক ভৌগোলিক ও পৌরাণিক মাহাত্ম্যের প্রেক্ষাপটের বিবরণ এবং ব্রজের মহাসাধকদের সাধনজীবনের বিশদ সত্যনিষ্ঠ বিবরণ)

* সেই বৃন্দাবনে লীলা অবিরাম (মূল্য ৬০/-) (সাধক লেখকের প্রথম শিষ্যা শার্মিলা রায় চ্যাটার্জীর বৃন্দাবনের পরম রহস্যময় দিব্যক্ষেত্র নিধুবনে শ্রীকৃষ্ণদর্শনের অপার্থিব অভিজ্ঞতার বিস্ময়কর বিবরণ)

* অরণ্যতীর্থ অমরকণ্টক (মূল্য ১২০/- টাকা) (তপোভূমি অমরকন্টকের সকল মহাতীর্থ ও গুপ্ত সাধনক্ষেত্র ভ্রমণকালে লেখকের অপূর্ব অভিজ্ঞতার বিশদ সত্যনিষ্ঠ বিবরণ এবং সেইসাথে সেই সকল তীর্থে দাঁড়িয়ে সেখানকার ঐতিহাসিক, পৌরাণিক ও আধ্যাত্মিক তত্ত্ব আলোচনার অনুপম বিবরণ)

Friday 22 March 2024

সত্যের আলোয় বাল্মীকির রামায়ণ। তিন (সর্গ ১৯ - ৩০) - তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় বিশ্বামিত্রের সঙ্গে শ্রীরামের বনগমন এবং তারকা বধ, মারীচ সুবাহু দমন ও বিশ্বামিত্রের যজ্ঞ রক্ষা।

সত্যের আলোয় বাল্মীকির রামায়ণ।
           - তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
 
     তিন -  বিশ্বামিত্রের সঙ্গে শ্রীরামের বনগমন এবং তারকা বধ, মারীচ সুবাহু দমন ও বিশ্বামিত্রের যজ্ঞ রক্ষা।

*                  *                  *

   শ্রীরামের বয়স তখন প্রায় ষোল। একদিন দশরথ রাজসভায় বসে তাঁর ছেলেদের বিয়ের কথা ভাবছিলেন এমনসময়ে একজন রাজপ্রহরী ছুটে এসে খবর দেয়, "মহারাজা, ঋষি বিশ্বামিত্র আপনার সাক্ষাতপ্রার্থী।" 
    এই খবর শুনে রাজা দশরথ অত্যন্ত প্রীত হলেন। বিশ্বামিত্রের যোগক্ষেমের খ্যাতি তাঁর অবিদিত ছিল না। তাই তিনি স্বয়ং এগিয়ে গিয়ে ঋষিকে অভ্যর্থনা করে তাঁর  রাজদরবারে নিয়ে গেলেন।  প্রথাগত সৌজন্যের পর, দশরথ সানন্দে ঋষিবর বিশ্বামিত্রকে বললেন, "এখানে আপনার আগমন দুর্ভিক্ষের সময় বৃষ্টিপাতের মতই আনন্দদায়ক। আমাকে অনুগ্রহ করে বলুন - আমি আপনার জন্য কি করতে পারি? আপনার আকাঙ্খাই আমার কাছে আদেশ। সেই আদেশ  জানতে পারলে আমি নিশ্চয় তা রাখব।'

   দশরথের উষ্ণ অভ্যর্থনায় বিশ্বামিত্র খুশি হলেন। তারপর সানন্দে বললেন, "আমার আকাঙ্ক্ষা কী তা আমি আপনাকে বলব বলেই তো এসেছি। বর্তমানে আমি একটি বিশেষ যজ্ঞ সম্পন্ন করার সংকল্প গ্রহণ করেছি।  কিন্তু দুজন শক্তিশালী রাক্ষসের জন্যে আমি এই যজ্ঞ পূর্ণ করতে পারছি না।  তারা আমার যজ্ঞবেদীতে কাঁচা মাংসের টুকরো নিক্ষেপ করে আমার যজ্ঞের আচার অনুষ্ঠানে বারবার ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। তাদের প্রতিরোধ করার  সমস্ত প্রচেষ্টা বৃথা হয়ে গেছে।  সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও আমি নিজে তাদের শাস্তি দিতে পারছি না যেহেতু এই যজ্ঞ আমার সংকল্প এবং যজ্ঞে বসার পর ওঠা অনুচিত। তাই আমার যজ্ঞবেদী পাহারা দিতে  আপনার পুত্র শ্রীরামকে  আমায় দশ দিনের জন্য দিন।   আমি নিশ্চিত যে শ্রীরামের সুরক্ষায় আমি এই যজ্ঞ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে পারব।  এর জন্য আমি তাকে এমন দক্ষতা এবং শক্তি প্রদান করব যা তাকে এই পৃথিবীতে বিশিষ্ট যশখ্যাতি এনে দেবে।  আমি স্বয়ং আপনাকে শ্রীরামের নিরাপত্তার আশ্বাস দিচ্ছি। আমি জানি শ্রীরাম আপনার অতি প্রিয়। কিন্তু তাই বলে আপনার পিতার ভালবাসা যেন আপনার ইতিপূর্বে দেয়া কথার সম্মান নষ্ট না করে।  আপনার মন্ত্রীগন এবং ঋষি বশিষ্ঠের মত সম্মানিত ঋষির সাথে পরামর্শ করে আপনার সিদ্ধান্ত আমাকে জানান।"

  ঋষির মুখে এহেন কথা শুনে রাজা দশরথ হতভম্ব হয়ে গেলেন। শ্রীরামই যে তাঁর কাছে সবকিছু। তাঁকে তিনি এভাবে ঋষির সাথে রাক্ষসদের সাথে যেতে দেন কিভাবে! তাই নিজেকে একটু সামলে নিয়ে তিনি বললেন,  "কিন্তু আমার পুত্র রাম তো এখনো বালক। তার বয়স এখনো ষোল হয় নি। যুদ্ধ বিদ্যা এখনো সে ঠিকমত আয়ত্ত করে নি। আর  রাক্ষসরা সকলেই কূটযোদ্ধা। রাম কোনমতেই তাদের সমকক্ষ নয়। তাই রাক্ষসদের সঙ্গে যুদ্ধ করবার যোগ্যতা তার নেই। তাছাড়া রামের বিচ্ছেদে আমি এক মুহূর্তও বাঁচতে পারব না। তাই যদি নিতান্তই তাকে নিয়ে যেতে চান তবে আমার চতুরঙ্গ সেনার সাথে আমাকেও নিন। আমার সেনাবাহিনী যথেষ্ট দক্ষ। তাদের সাথে আমি স্বয়ং ধনুর্ধারণ করে প্রাণপণে রাক্ষসদের সঙ্গে যুদ্ধ করব।" তারপর একটু থেমে তিনি বললেন, "তবে এই রাক্ষসরা কারা যারা আপনার যজ্ঞে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে?'

 বিশ্বামিত্র বললেন, "এরা হল মারীচ এবং সুবাহু। এরা লঙ্কার রাজা রাবণের অনুগামী। রাবণের আদেশ অনুসারে এরা কাজ করে। যদিও রাবণের জন্ম ঋষি পুলস্ত্যের বংশে এবং মহান ঋষি বিশ্রবা তার পিতা, কিন্তু ব্রহ্মার বর তাকে বর্তমানে করেছে নির্মম অত্যাচারী এবং অহংকারী। যেখানে সে নিজে যায় না সেখানে সে তার অনুগামী এইসব রাক্ষসদের পাঠায় সাধুদের উপর অত্যাচার করতে।" 
    রাবণের নাম শুনে দশরথ ভয়ে অস্থির হয়ে উঠলেন। তিনি উত্তর দিলেন, " রাবণ তো বিরাট শক্তিশালী রাক্ষস। দেব দানব গন্ধর্ব যক্ষ বা নাগ কেউ যুদ্ধে রাবণের সাথে  এঁটে উঠতে পারে না। মানুষ তো দূর অস্ত। অতএব, আমি সসৈন্যে বা আমার পুত্রকে নিয়ে রাবণের সঙ্গে বা তার অনুচরদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারব না। আপনি আমার ও আমার ছেলে রামের প্রতি দয়া করুন।" অর্থাৎ দেখাই যাচ্ছে যে দশরথ প্রথমে আবেগের বশে কথা দিয়ে ফেললেও পরে অসুবিধা দেখলে কথা ফেলতেও দ্বিধা করেন না। রঘুবংশীয়দের সনাতন রীতি "প্রাণ যায় পর বচন না যায়" তিনি বড় একটা মানতে চান না।
    স্বাভাবিকভাবেই দশরথের এরকম উত্তরে বিশ্বামিত্র মোটেও খুশি হলেন না।  তিনি বরং ব্যঙ্গাত্মকভাবে বললেন, 'আপনি তাহলে কেন কথা দিয়েছেন যে আপনি আমার ইচ্ছা পূর্ণ করবেন। শুনেছি রঘুবংশীয়রা প্রাণ দিয়েও কথা রাখে। কথা দিয়েও কথা না রাখা রঘুর বংশের বংশের কাছে খুবই অপ্রীতিকর।  তবে আপনি যদি বিশ্বাস করেন যে আপনি যা করছেন তা সঠিক, তাহলে তাই হোক।  আমি যেভাবে এসেছি সেভাবেই চলে যাব।
আপনি শপথ করেও তা না রেখে আপনার অনুগামীদের নিয়ে সুখী থাকুন।"
    ঋষি বিশ্বামিত্রের ক্রোধ দেখে এবার রাজগুরু ঋষি বশিষ্ঠ হস্তক্ষেপ করলেন। কারণ তিনি গুরু। শিষ্যের মঙ্গল দেখা তাঁর কর্তব্য। তিনি চোখের সামনে দেখছেন যে শিষ্য কথা দিয়েও কথার খেলাপ করতে চলেছেন। পুত্রমোহে অন্ধ হয়ে তিনি পুত্রের কিসে সত্যিই ভালো হবে তা দেখতে পারছেন না। অতএব পরম স্নেহাস্পদ দশরথ ও শ্রীরামের কল্যাণের দিকে চেয়ে তিনি দশরথকে বোঝালেন,
 "দশরথ, তুমি তোমার বিচক্ষণতা, সত্যবাদিতা এবং নিজের দেয়া কথার সম্মান রাখার জন্য সুপরিচিত।
তাই কথা দিয়েও মোহের বশে কথা না রেখে অঙ্গীকার ভেঙে নিজেকে অপমানিত কোর না। ঋষি বিশ্বামিত্রকে আমি যেভাবে জানি তা কেউ জানে না।  তাঁর তপস্যা অপরিসীম।  তাঁর পরাক্রম অভূতপূর্ব।  এমন কোন অস্ত্র নেই যার জ্ঞান এই ঋষির নেই।  তাঁর তত্ত্বাবধানে রামের কোনো ক্ষতি হতে পারে না।  তিনি নিজেই রাক্ষসদের শাস্তি দিতে সক্ষম।  তবুও, তিনি রামকে বেছেছেন, নিজের জন্য নয়, রামকেই আগামীদিনের জন্যে যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী করে তুলতে। তাই রামকে তুমি যেতে দাও। এতে তার মঙ্গলই হবে।"
   গুরু বশিষ্ঠের কথায় রাজা দশরথ অবশেষে শ্রীরামকে বিশ্বামিত্রের সঙ্গে পাঠাতে সম্মত হলেন। আর শ্রীরামের সাথে সবসময়ে ছায়ার মত থাকেন লক্ষ্মণ। তাই তিনিও এলেন সঙ্গে। উভয়কেই রাজা দশরথ স্বস্তয়নের পর ঋষি বিশ্বামিত্রের হাতে সমর্পণ করলেন। বিশ্বামিত্র দুই ভাইকে সঙ্গে নিয়ে অগ্রসর হলেন তাঁর
সিদ্ধাশ্রমের লক্ষ্যে। 
       সিদ্ধাশ্রম ছিল অযোধ্যা থেকে চারদিনের পথ। সেই পথে পদব্রজে বিশ্বামিত্র এগিয়ে চললেন এবং শ্রীরাম লক্ষ্মণ তাঁকে অনুসরণ করতে লাগলেন। দুই রাজকুমারের কাঁধে ছিল ধনুক এবং তাঁদের পিঠে ছিল তীরভর্তি তুণ। কোমরে ঝোলানো ছিল তেজস্বী তলোয়ার। যদিও দুজনেই রাজার কুমার। এবং বড় হয়েছেন মহলের আরাম ও বিলাসের মাঝে, কিন্তু তাও ঋষির সাথে তপস্বী বালকের মত পদব্রজে গভীর অরণ্যের মধ্য দিয়ে পথ চলতে তাঁদের কোন অসুবিধা হয় নি। কারণ গুরু বশিষ্ঠ যে তাঁদের সেভাবেই গড়ে তুলেছিলেন। তাই প্রয়োজনে সবরকম কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে তাঁরা অভ্যস্ত ছিলেন।
    এইভাবে  অযোধ্যা অতিক্রম করে প্রায় দেড় যোজন চলার পর সরযূ নদীর দক্ষিণ তীরে এসে ঋষি বিশ্বামিত্র থামলেন। তিনি এখানে শ্রীরামকে ও লক্ষ্মণকে বল এবং অতিবল বিদ্যা দান করেন। এই বিদ্যাদান ছিল শক্তিশালী মন্ত্র অনুষ্ঠান যা একমাত্র কোন দক্ষ গুরু দিতে পারেন শিষ্যকে। এই মন্ত্র সঙ্গে থাকলে তাঁরা নির্ধারিত কাজে নিযুক্ত থাকার সময় কোনও শারীরিক ব্যথা বা মানসিক ক্লান্তি অনুভব করবেন না এবং তাঁরা ঘুমিয়ে থাকার সময়েও শত্রুদের দ্বারা কখনই পরাভূত হবেন না। এমনকি  ক্ষুধা বা তৃষ্ণাও কখনোই তাঁদের কষ্ট দিতে পারবে না।"
    এককথায়, দুই রাজপুত্রকে ঋষি বিশ্বামিত্রের এই বিদ্যাদানের উদ্দেশ্য ছিল - তাঁদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা এবং ক্লান্তি থেকে সুরক্ষা জোগানো এবং সেইসাথে তাদের মধ্যে অপরিমেয় শক্তি এবং জ্ঞানের সঞ্চার করা।
      তাঁরা তিনজন সেই রাত কাটিয়েছিলেন সরযূর তীরে। ঋষির সাথে অযোধ্যার এই দুই রাজপুত্র বিস্তীর্ণ আকাশের নীচে তৃণশয্যাতেই  ঘুমাতেন যা কোন রাজকুমারের ক্ষেত্রে বেশ ক্লেশদায়ক কিন্তু বিশ্বামিত্রের মধুর ব্যবহার তাঁদের মধ্যে কোন ক্লেশ জাগতে দেয় নি।  বিশ্বামিত্র প্রতি রাতে যেমন  সস্নেহে অনেক কিছু উপদেশ তাঁদের দিয়েছেন তেমনিই তাঁরাও সম্মান ও আনুগত্যের সাথে তাঁর কাছ থেকে আহরণ করেছেন অনেক বিরল জ্ঞান।
   পরদিন ভোরবেলা ঋষি আবার শুরু হল তাঁদের যাত্রা। দ্বিতীয় সন্ধ্যায় তাঁরা সরযূ ও গঙ্গা নদীর সঙ্গমস্থলে অঙ্গদেশের একটি আশ্রমে এসে পৌঁছলেন।  সেখানে এসে বিশ্বামিত্র তাঁদের জানালেন যে পূর্বে এখানে কন্দর্পের আশ্রম ছিল। একবার মহাদেব যখন এখান দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন কন্দর্প তাঁর চিত্তবিকার উৎপাদন করেন। ফলে ক্রুদ্ধ হন মহাদেব। রুদ্রের ক্রোধদৃষ্টিতে কন্দর্পের সর্বাঙ্গ ভস্মীভূত হয়ে যায়। সেই থেকে তাঁর নাম হয় অনঙ্গ এবং এই স্থানের নাম অঙ্গদেশ। তাঁরই শিষ্যরা পুরুষানুক্রমে এই স্থানে বাস করেন। আশ্রমবাসী মুনিরা বিশ্বামিত্রের এখানে আগমনে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তাঁদের তিনজনের যথোচিত সৎকার এবং রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করে দেন। 
   পরদিন তিন জনে গঙ্গাতীরে এসে নৌকায় উঠলেন গঙ্গা পার হবার জন্য। নদীর মধ্যে এসে শ্রীরাম সহসা শুনতে পেলেন - জলের ভিতর থেকে একটা প্রবল আলোড়ন উঠছে। তিনি কৌতূহলবশে জিজ্ঞাসা করলেন, "আমরা যে জল ভেদ করে যাচ্ছি তার ভিতর থেকে এই তুমুল শব্দ জাগছে কেন?"
    বিশ্বামিত্র বললেন,
"আসলে এই স্থান যে দুই নদীর সঙ্গম। এখান থেকে অযোধ্যার দিকে যে পুণ্যতোয়া নদী গেছে দেখছ তা ব্রহ্মার মানস থেকে সৃষ্ট কৈলাশের মানস সরোবর থেকে নিঃসৃত। তাই এই নদীর  নাম সরযূ। সেই নদী এখানে গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই দুই নদীর মিলনের ফলেই দুই বিপরীতমুখী জলধারার সঙ্গমের ফলেএই প্রচণ্ড শব্দ হচ্ছে। রাম, তুমি মনঃসংযম করে এই সঙ্গমে প্রণাম কর।"
     শ্রীরাম লক্ষ্মণ ওই দুই নদীকে প্রণাম করে ঋষির সঙ্গে এলেন দক্ষিণ তীরে। শ্রীরাম দেখলেন - এখান  থেকে পথ গেছে এক শ্বাপদসংকুল ঘোর অরণ্যের দিকে। বনের মধ্য থেকে বন্য প্রাণী, পাখি এবং কীটপতঙ্গের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়। সেখানে কোন মানুষের বসতি আছে বলে মনে হচ্ছিল না।
    এই ঘোর অরণ্যের দিকে চেয়ে শ্রীরামকে বিশ্বামিত্র বললেন, "এই অরণ্য অতীতে ছিল এক বিরাট জনপদ। বৃত্রাসুরকে বধ করার সময় ইন্দ্র মললিপ্ত, ক্ষুধিত ও ব্রহ্মহত্যার পাপে আক্রান্ত হয়েছিলেন। দেবতা ও ঋষিগণ এই স্থানে তাঁকে স্নান করিয়ে তাঁর মল পরিষ্কার করেন এবং নানা সুখাদ্য খাইয়ে তাঁর ক্ষুধা মেটান। এখানে ইন্দ্রের মল ও করুষ (ক্ষুধা) দূর হওয়ায় তাঁর বরে এখানে মলদ ও করুষ নামে দুই সমৃদ্ধ জনপদ স্থাপিত হয়। কিছুকাল পরে তাড়কা এসে এই  দুই জনপদ ধ্বংস করে দেয়।"
    শ্রীরাম জিজ্ঞাসা করেন, "তাড়কা কে?
  বিশ্বামিত্র বলেন, " তাড়কা মূলতঃ ছিল একজন যক্ষী। যক্ষ সুকেতু ব্রহ্মার তপস্যা করে তাড়কাকে কন্যারূপে পায়। ব্রহ্মার বরে তাড়কার মধ্যে সঞ্চারিত হয় সহস্র হাতীর বল। জম্ভুপুত্র সুন্দের সঙ্গে তার বিবাহ হয় এবং সুন্দের ঔরসে সে এক পুত্র লাভ করে। তার নাম মারীচ। সুন্দ অগস্ত্য মুনির হাতে বিনাশপ্রাপ্ত হয়। তখন প্রতিশোধ নিতে তাড়কা ও মারীচ অগস্ত্যকে ভক্ষণ করতে যায়। কিন্তু অগস্ত্যকে ভক্ষণ করার সাধ্য তাদের ছিল না। পরিবর্তে অগস্ত্যর শাপে দুজনেই রাক্ষসযোনি প্রাপ্ত হয়। সেই তাড়কা এই বনে বাস করে। এই বন পেরোতে হলে তাড়কাকে বধ করা ছাড়া গতি নেই।"
    শ্রীরাম কিন্তু তাড়কাকে বধ করতে রাজী ছিলেন না। তাড়কা যে মহিলা। ধর্ম অনুসারে স্ত্রীলোক যে অবধ্য। বিশ্বামিত্র সহজেই রামের মনের কথা পড়ে নিলেন। তাই তিনি বললেন,"তাড়কার মত একজন মহিলাকে হত্যা করার বিষয়ে তোমার বিতৃষ্ণা  পোষণ করা উচিত নয়। তুমি একজন রাজপুত্র। তাই তোমার প্রজাদের স্বার্থে যেটা মঙ্গল সেটা অবশ্যই করতে হবে। একজন রাজার বা রাজপুত্রের জন্য তার নাগরিকদের সুরক্ষা এবং কল্যাণকে সর্বাগ্রে রাখতে হয়। প্রজাদের মঙ্গলের স্বার্থে, একজন রাজার যে কোন ধরনের পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত থাকা উচিত - তা যতই কঠোর বা দৃশ্যত পাপপূর্ণ হোক না কেন! এটি প্রকৃতপক্ষে রাজ্য শাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সকল রাজাদের জন্যই নির্ধারিত ধর্ম।  তাই, দ্বিধা না করে এই রাক্ষসীকে বধ কর। এতে অধর্মের নাশ হবে।"
      এই বলে রাম ধনুকে টঙ্কার দিলেন। ওই টঙ্কারের প্রবল শব্দে এই বিজন অরণ্যের জীবজন্তু সব ভয়ে সশব্যস্ত হয় উঠল। নিশাচরী তাড়কা সেই প্রচণ্ড শব্দ শুনে মহাক্রোধে ছুটে এল তাঁদের সামনে। তখন মহাবীর শ্রীরাম সেই  বিকৃতদর্শনা দীর্ঘাঙ্গী নিশাচরীকে লক্ষ্য করে লক্ষ্মণকে বললেন," লক্ষ্মণ! এই যক্ষিণীর আকার দেখ কি ভয়ঙ্কর! একে দেখলে  সকলেরই হৃদয় কম্পিত হতে বাধ্য। তবু এ যে  নারী।সেজন্যেই একে বধ করতে আমার  মন কোনমতেই  সায় দিচ্ছে না। আমি তাই এই মায়াবিনীর নাক কান কেটে একে দূর থেকেই নিবৃত্ত করছি।" ( এর থেকেও বোঝা যায় শ্রীরাম নারীদের প্রতি কিরকম মনোভাব রাখতেন। যিনি তাড়কার মত একজন ভয়ংকর আতঙ্কবাদী রাক্ষসীকে নারী বলে বধ করতে চান না, তিনি কিভাবে নিজের প্রেয়সী স্ত্রী সীতা দেবীকে বিনাদোষে  অগ্নিপরীক্ষা দিতে বলবেন সকলের সামনে? এগুলি যে উত্তর কবিদের মাধ্যমে রামায়ণে পরে আরোপিত হয়েছে তা আমরা এই রামায়ণ পাঠ করতে করতে  বারবার দেখতে পাব।)
       যাহোক, শ্রীরাম যখন লক্ষ্মণকে এই কথা বলছিলেন সেই অবসরে তাড়কা ক্রোধে অধীর হয়ে হাত তুলে তর্জন গর্জন করতে করতে তাঁরই দিকে দ্রুতগতিতে ছুটে আসতে লাগল এবং আকাশে ধুলো ঝড়ের মায়াজাল বিস্তার করে রাজকুমারদের উপর অনবরত বিশাল বিশাল পাথর এবং গাছের গুঁড়ি ছুঁড়তে শুরু করল। তখন শ্রীরাম আর ক্রোধ সংবরণ করিতে পারলেন না। তিনি শরাঘাতে এই রাক্ষসীর শিলাবর্ষণ নিবারণ করে তার হাতদুটি খণ্ড খণ্ড করিয়া কেটে ফেললেন। কিন্তু তাও তাড়কা থামতে রাজি নয়। সে তাঁদের সামনে এসে আস্ফালন করতে লাগিল। এই দেখে ক্রুদ্ধ লক্ষ্মণ তৎক্ষণাৎ তার নাক কান কেটে দিলেন। তবু তাড়কা নানারকম রূপ ধারণ করে প্রচ্ছন্নভাবে রাক্ষসী মায়ায় রাম ও লক্ষ্মণকে বিমোহিত করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগল।
    শ্রীরাম যে তাড়কাকে নারী রূপে দেখে বধ করতে ইতস্তত করছেন তা অনুভব করতে মহর্ষি বিশ্বামিত্রের সময় লাগল না। তিনি কঠোরভাবে শ্রীরামকে বললেন, "রাম! তুমি নারী বলে এই রাক্ষসীকে বিন্দুমাত্র দয়া কোর না। এই যজ্ঞনাশিনী পাপীয়সী ক্রমশই নিজের মায়াবল পরিবর্ধিত করবে। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলে এমনিতেই রাক্ষসরা দুর্নিবার হয়ে ওঠে। তাই সূর্য ডোবার আগেই  তুমি তাড়কাকে বধ কর। নাহলে অন্ধকার নামলে সে অপরাজেয় হয়ে উঠবে।"
      বিশ্বামিত্রের এই সাবধানবাণী শুনে শ্রীরাম তাড়কাকে বধ করতে প্রস্তুত হলেন। এদিকে তাড়কা সাংঘাতিকভাবে আহত হয়েও সিংহনাদ করতে করতে ছুটে আসছিল শ্রীরাম লক্ষ্মনের দিকে। শ্রীরাম তখন তাড়কার উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করলেন এক প্রাণঘাতী বাণ। বাণটি পলকের মধ্যে তাড়কার বুক চিরে করল
নিখুঁত লক্ষ্যভেদ। অবশেষে তাড়কা মৃত্যুবরণ করে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। 
       ইন্দ্রসহ দেবতারা এতক্ষণ আকাশে থেকে এই যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করছিলেন। তাঁরা তাড়কাকে শ্রীরামের হাতে মৃত্যুবরণ করতে দেখে আনন্দিত হয়ে বিশ্বামিত্রকে বললেন, "ঋষিবর আপনার মঙ্গল হোক। আপনি এখন আপনার স্নেহের নিদর্শনস্বরূপ শ্রীরামের হাতে প্রজাপতি কৃশাশ্বের তপোবলসম্পন্ন অস্ত্রসকল সমর্পণ করুন। রাম আপনার এই দান গ্রহনের জন্যে একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি।" 
    দেবতাদের কথায় সানন্দে রাজি হলেন বিশ্বামিত্র। এমনিতেই শ্রীরামের এই যুদ্ধে বীরত্ব ও দক্ষতা প্রদর্শনের কৃতিত্বে সন্তুষ্ট ছিলেন বিশ্বামিত্র। তাই শ্রীরামকে কিছু দিতে তাঁরও মন চাইছিল। তবে তখন তো রাত হয়ে গেছে। তাই প্রভাতের প্রতীক্ষা ভিন্ন গতি নেই। সেই রাতে তাঁরা এই বিজন বনেই বাস করলেন।
      পরদিন যথাসমযয়ে পূর্বের আকাশে দেখা দিল নতুন সূর্য্য। শ্রীরাম লক্ষ্মণের অযোধ্যা ছাড়ার পর এটি ছিল চতুর্থ দিন।
  সেদিন সকালে বিশ্বামিত্র  মধুরস্বরে শ্রীরামকে বললেন, "রাম, আমি তোমাকে অদ্ভুত শক্তিশালী দিব্যাস্ত্রসমূহ আজ প্রদান করব। এই সমস্ত অস্ত্র হল প্রজাপতি কৃশাম্বের তনয়স্বরূপ। এই সকল অস্ত্রের প্রভাবে তুমি দেব অসুর গন্ধর্ব সকলকেই পরাস্ত করতে পারবে। আমি এবার তোমাকে দিব্য দণ্ডচক, ধর্মচক্র, কালচক্র, বিষ্ণু চক্র, অতি উগ্র ঐন্দ্রচক্র, বজ্র, শৈব শূল, ব্রহ্মশির অস্ত্র, ইষীকাস্ত্র, ব্রাহ্ম অস্ত্র, মৌদকী ও শিখরী নামের দুই গদা, ধর্ম- পাশ, কাল-পাশ, বারুণ-পাশ, শুষ্ক ও আর্দ্র নামের দুই অশনি, পিনাকাস্ত্র, নারায়ণাস্ত্র, শিখর  আগ্নেয়াস্ত্র, মুখ্য বায়বাস্ত্র, হরশির অস্ত্র, ক্রৌঞ্চাস্ত্র, শক্তিদ্বয়, কঙ্কাল, মুষল, কাপাল ও কিঙ্কিণী, বৈদ্যাধর অস্ত্র, নন্দন অসিরত্ন, মোহন  গান্ধর্ব অস্ত্র, প্রস্বাপনাস্ত্র, প্রশমনাস্ত্র, সৌম্যাস্ত্র, বর্ষণাস্ত্র, শোষণাস্ত্র, সন্তাপনাস্ত্র, বিলাপনাস্ত্র, অনঙ্গের প্রিয় মাদনাস্ত্র, মানব গান্ধর্বাস্ত্র ও মোহন পৈশাচাস্ত্র, তামসা, মহাবল সোমনাস্ত্র, দুর্ধর্ষ সম্বর্তাস্ত্র, মৌষলাস্ত্র, সত্যাস্ত্র, মায়াময়াস্ত্র, শত্রুতেজোপকর্ষণ তেজঃপ্রভ নামের সৌরাস্ত্র, সোমাস্ত্র, শিশিরস্ত্র, তাষ্ট্র অস্ত্র, ও শীতশর প্রভৃতি অস্ত্র প্রদান করছি।"
  এরপর বিশ্বামিত্র এই সমস্ত দেবদূর্লভ মন্ত্রাত্মক অস্ত্র শ্রী রামকে প্রদান করবার জন্য পূর্বমুখী হয়ে ধ্যান করতে লাগলেন। তখন সমস্ত দিব্যাস্ত্রজাল শ্রীরামের সামনে আবির্ভূত হয়ে হৃষ্টচিত্তে জানাল, "রাঘব! আমরা নিজেদের আপনাকে সমর্পণ করলাম। আপনার এখন যেরকম অভিপ্রায়, সেইমত আমরা কাজ করব।*
    শ্রীরাম তখন প্রসন্ন মনে তাঁদের স্পর্শ করে বললেন, "হে দিব্যাস্ত্রগণ! যখন আপনাদের স্মরণ করব তখন আপনারা আমার কাছে উপস্থিত হবেন।" শ্রীরাম অস্ত্রদের এই বলে প্রতিমানসে বিশ্বামিত্রকে প্রণাম জানালেন।
   তারপর বিশ্বামিত্র  শ্রীরামকে প্রতিটি অস্ত্রের প্রয়োগ ও সংহারমন্ত্র শিখিয়ে দিলেন যার মাধ্যমে বিমুক্ত অস্ত্র আবার ফিরিয়ে আনা যায়। এইভাবে শ্রীরামকে নানা দৈব অস্ত্রে বলীয়ান করে বিশ্বামিত্র তাঁদের নিয়ে যাত্রা করলেন তাঁর সিদ্ধাশ্রমের দিকে। 
     সিদ্ধাশ্রমের পথে যেতে যেতে সহসা শ্রীরামের চোখে পড়ল দূরে পর্বতের কোলে একটি মেঘের মত সুদৃশ্য তপোবন। হাঁটতে হাঁটতেই শ্রীরাম বিশ্বামিত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন, "ওই পর্বতের গায়ে যে তপোবন দেখা যাচ্ছে ওখানে কার আশ্রম রয়েছে?"
  বিশ্বামিত্র বললেন, "ওইখানে বিষ্ণু বামন অবতারে তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। তাই ওখানকার  নাম সিদ্ধাশ্রম। একবার বিরোচনপুত্র বলি ইন্দ্রাদি দেবগণকে যুদ্ধে হারাবার পর  একটি যজ্ঞের আয়োজন করেন। তখন দেবতারা  বিষ্ণুকে বললেন, 'দানবরাজ বলির যজ্ঞে যাচকরা যা প্রার্থনা করছেন তাই পাচ্ছেন। আপনি বামনরূপে  সেখানে যান এবং দেবতাদের হিতার্থে বলির থেকে ইপ্সিত দান নিয়ে তার আধিপত্য খর্ব করুন।'
   যখন দেবতারা বিষ্ণুকে বামনরূপে অবতীর্ণ হতে অনুরোধ করেন, সেই সময়ে  ভগবান্ কাশ্যপ তাঁর স্ত্রী দেবী অদিতির সাথে দিব্য হাজার বছর ধরে একটি ব্রত পালন করছিলেন। ব্রত শেষে ভগবান বিষ্ণু যখন তাঁকে দর্শন দিলেন তখন তিনি বর চাইলেন", হে দেব! আপনি স্বয়ং তপোমূর্তি ও জ্ঞান স্বরূপ অনাদি ও অনন্ত। ভগবন! আমাদের প্রার্থনা , আপনি অদিতির গর্ভে আমার পুত্ররূপে আবির্ভূত হোন।"
   অতঃপর বিষ্ণু দেবী অদিতির গর্ভে বামনরূপে জন্মগ্রহণ করেন এবং তারপর যথাসময়ে বামন রূপ ধরে দানবরাজ বলির কাছে উপস্থিত হন। বলি তাঁকে দান যাচনা করতে অনুরোধ করেন। তখন বামনদেব  ত্রিপাদ ভূমি ভিক্ষা চান বলির কাছে এবং লোক হিতার্থে দুই পায়ে ত্রিলোক অধিকার করে নেন এবং তৃতীয় পা বলির মাথায় স্থাপন করে তাঁকে নিজের বশে নিয়ে আসেন। এইভাবে বামন বলিকে বন্ধন করে দেবতাদের ফিরিয়ে দেন ত্রিলোক। সেই বামনদেব আগে এই শ্রমনাশন আশ্রমে বাস করতেন। এখন আমি তাঁরই প্রতি ভক্তিপরায়ণ হয়ে এই আশ্রমে আছি।  নিশাচর রাক্ষসরা এখানে এসেই আমার যজ্ঞে বিঘ্ন ঘটিয়ে  থাকে। এখানেই তোমাদের সেই দুরাচারীদের বিনাশ করতে হবে। আজি আমরা সেই সর্বোৎকৃষ্ট সিদ্ধাশ্রমে পৌঁছব।"
   সেদিন সন্ধ্যায় তাঁরা সিদ্ধাশ্রমে পৌঁছলেন। সেখানে পৌঁছে কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর  শ্রীরাম এবং লক্ষ্মণ সবিনয়ে বিশ্বামিত্রকে জানান যে তিনি এবার যজ্ঞর জন্যে প্রস্তুত হতে পারেন কারণ তাঁরা দুই ভাই এবার যজ্ঞভূমি পাহারা দেয়ার জন্যে প্রস্তুত। 
    যথাসময় বিশ্বামিত্র যজ্ঞের সূচনা করেছিলেন।  যজ্ঞে বসতে হলে ঋষিদের কিছু আচার বিচার অনুসরণ করতে হয়। তার মধ্যে একটি হল মৌন ব্রত। অর্থাৎ আসন্ন যজ্ঞে বসার পর ছয় দিন ও রাত্রি, বিশ্বামিত্র একটি শব্দও বলবেন না। শুধুমাত্র যজ্ঞের দিকেই  থাকবে তাঁর মনোনিবেশ। আর এই জন্যেই তাঁর নিজের যজ্ঞে বিঘ্নকারী অসুরদের শাস্তি দেয়া সম্ভবপর ছিল না। তাই শ্রীরাম এবং লক্ষ্মণকে এই যজ্ঞ রক্ষা করার জন্যে সুদূর অযোধ্যা থেকে নিয়ে আসতে হয়েছিল তাঁকে।
    যথাসময়ে শুরু হল যজ্ঞ। এরপর পাঁচ দিন রাত বেশ শান্তিতেই কাটল কোন উপদ্রব ছাড়া। কিন্তু ষষ্ঠ দিন  ভোরে যখন বিশ্বামিত্রের বৈদিক মন্ত্রের উচ্চারণে আকাশ  বাতাস ভরে উঠল, শ্রীরামের মনে হল - এবার বিপদ আসন্ন। শ্রীরাম লক্ষ্মণকে তৎক্ষণাৎ বললেন,"এবারই সুবাহু এবং মারীচ যজ্ঞ পণ্ড করতে  আসবে মনে হচ্ছে। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে আরো।" শ্রীরাম যখন এই কথা বলছিলেন, তখনই সহসা আকাশে বজ্রপাতের মত একটি প্রচণ্ড শব্দ প্রতিধ্বনিত হল। শ্রীরাম তৎক্ষণাৎ মাথা তুলে দেখতে পেলেন -  দুই রাক্ষস সুবাহু এবং মারীচ তাদের দলবল নিয়ে আশ্রমের দিকে আকাশপথে ছুটে আসছে। আর আকাশ থেকে তারা চারিদিকে রক্তের স্রোত ছড়িয়ে দিচ্ছে। বলেই বাহুল্য যে যজ্ঞ অপবিত্র করাই তাদের লক্ষ্য।
  শ্রীরাম সেদিকে চেয়ে লক্ষ্মণকে বললেন, "লক্ষ্মণ!  আমি এই সাধারণ অল্পপ্রাণ রাক্ষসদের বিনাশ করতে চাই না। বরং মানবাস্ত্র দিয়ে বায়ুবেগে মেঘের মত এই সমস্ত দুরাচারী মাংসাশী প্রাণীদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছি।"  এই বলে তিনি ধনুকে তেজদীপ্ত মানবাস্ত্র যোজনা করে মারীচের উপর নিক্ষেপ করলেন। মারীচ সেই মানবাস্ত্রর আঘাতে আহত হয়ে শত যোজন দূরে মহাসাগরে গিয়ে পড়ল।  কিন্তু তবু রাক্ষসরা আক্রমণ বন্ধ করল না।  তাই এবার শ্রীরাম অবিলম্বে ধনুকে কার্মুক আগ্নেয়াস্ত্র সন্ধান করে  সুবাহুর বুকের উপর তা নিক্ষেপ করলেন। সুবাহু সেই  আগ্নেয়াস্ত্রর আঘাতে তৎক্ষণাৎ মাটিতে পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করল। এরপর  শ্রীরাম বায়বাস্ত্র ব্যবহার করে অবশিষ্ট রাক্ষসদের বধ করলেন।
     এইভাবে রাক্ষসদের আক্রমণ প্রতিরোধ করে শ্রীরাম যজ্ঞ রক্ষা করলেন। এতে আশ্রমের মহর্ষিদের আনন্দের আর পরিসীমা রহিল না। তাঁরা দেবাসুর সংগ্রামে বিজয়ী ইন্দ্রের মতই শ্রীরামের সমাদর করতে লাগলেন। 
  অবশেষে যথাসময়ে মহর্ষি বিশ্বামিত্র নির্বিঘ্নে যজ্ঞ শেষ করলেন এবং যজ্ঞস্থল  নিষ্কণ্টক দেখে সানন্দে শ্রীরামকে বললেন, "বৎস! আমি সত্যিই কৃতার্থ হলাম। তুমি তোমার কর্তব্য যথার্থই পালন করেছ - আমাদের যজ্ঞ রক্ষা করেছ এই দুরাচারী রাক্ষসদের থেকে।"  
  বিশ্বামিত্র এইভাবে শ্রীরামের  প্রশংসা করে তাঁকে এবং লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে এবার সন্ধ্যা উপাসনা করবার জন্য প্রস্তুত হলেন।
      (ক্রমশ)

#বাল্মীকি #রামায়ণ #শ্রীরামচন্দ্র #balmiki #ramayana #rama #tarashisgangopadhyay #tarashisauthor #devotional #spiritual #epic

Tuesday 19 March 2024

সত্যের আলোয় বাল্মীকির রামায়ণ। - তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় দুই - শ্রীরামের ধরাধামে আবির্ভাব প্রসঙ্গ এবং রামায়ণ যে আর্য অনার্যের যুদ্ধ নয় তার প্রমাণসহ বিশদ আলোচনা।

সত্যের আলোয় বাল্মীকির রামায়ণ।
           - তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
 
     দুই - (সর্গ ৫ - ১৮)  শ্রীরামের ধরাধামে আবির্ভাব প্রসঙ্গ এবং রামায়ণ যে আর্য অনার্যের যুদ্ধ নয় তার প্রমাণসহ বিশদ আলোচনা।

*                 *                *

    শ্রীরামচন্দ্র অশ্বমেধ যজ্ঞের সভায় সানন্দে চেয়ে থাকেন তাঁর প্রতিবিম্বস্বরূপ দুই বালক লব কুশের দিকে। নৃপতির স্নেহদৃষ্টিতে মুগ্ধ হয়ে শ্রীরামের দিকে চেয়ে লব কুশও শুরু করেন মধুর কণ্ঠে রামায়ণ গান -

যাঁদের বংশে সগর রাজা জন্মেছিলেন, যাঁর গমনকালে ষাট হাজার পুত্র অনুগমন করতেন, যিনি সাগর খনন করিয়েছিলেন, সেই ইক্ষাকুদের বংশ এই রামায়ণে কীর্তিত হয়েছে। আমরা ধর্ম-কাম-অর্থ যুক্ত এই আখ্যান আদ্যন্ত গান করব। আশা করব আপনারা সবাই অসূয়াশূন্য হয়ে এই গান শুনবেন।

সরযূতীরে কোশল নামে এক আনন্দময় সমৃদ্ধিশালী  ধনধান্য- সম্পন্ন বিরাট জনপদ আছে। তার রাজধানী হল অযোধ্যা। স্বয়ং মানবেন্দ্র মনু এই পুরী নির্মাণ করেছিলেন। এই সুদৃশ্য মহানগরী দ্বাদশ যোজন দীর্ঘ, তিন যোজন বিস্তৃত এবং প্রশস্ত মহাপথ  ও রাজমার্গে  সুবিভক্ত। এই সকল পথ বিকশিত পুষ্পে অলংকৃত এবং নিত্য জলসিক্ত। রাজা দশরথ অমরাবতীতে ইন্দ্রের মতই এই অযোধ্যায় বাস করতেন। এই শ্রীসম্পন্ন অতুলপ্রভাসমন্বিত পুরী উঁচু উঁচু অট্টালিকা ও ধ্বজাসমূহে শোভিত। এখানে বহু স্থানে পুরনারীদের জন্য নাট্যশালা, উদ্যান ও আমবন আছে। নগরীর চতুর্দিক শালবনে বেষ্টিত। দুর্গম গভীর পরিখা থাকায় সেখানে অন্যের প্রবেশ দুঃসাধ্য। 

     সেই অযোধ্যায় বেদজ্ঞ দূরদর্শী মহাতেজস্বী রাজা দশরথ রাজত্ব করতেন। সেখানকার লোকেরা সুখী, ধর্মপরায়ণ, শাস্ত্রজ্ঞ, নির্লোভ ও সত্যবাদী ছিল। অযোধ্যায় কামাসক্ত, নীচ প্রকৃতির নৃশংস পুরুষ, অবিদ্বান,  নাস্তিক, মিথ্যাবাদী, অল্পশাস্ত্রজ্ঞ, অসূয়াপরবশ বা অসমর্থ কেউ ছিল না।
   দশরথ দক্ষতার সঙ্গে রাজ্য শাসন করতেন । তাই তাঁর রাজ্যে শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় থাকত। রাজগুরু ঋষি বশিষ্ঠ এবং ঋষি বামদেবের সৎ পরামর্শ রাজাকে সৎপথে রাজ্যশাসন করতে সাহায্য করত। দশরথের মন্ত্রীরা ছিলেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী এবং  নীতি, অর্থনীতি ও প্রশাসনের বিশেষজ্ঞ। তাঁরা জানতেন কিভাবে কোষাগার  সমৃদ্ধ করতে হয়, সেনাবাহিনীকে ভালভাবে পরিচালনা করতে হয় এবং গোপনীয়তা বজায় রাখতে হয়। অযোধ্যার বিচার ব্যবস্থা বড় ভাল ছিল। সেখানে কখনো দোষীদের ছাড়া হত না এবং নিরপরাধ কখনো শাস্তি পেত না। এমনই ছিল অযোধ্যার খ্যাতি ও জাঁকজমক। এহেন অমরাবতীতুল্য অযোধ্যার রাজা দশরথ সম্পর্কে বলা হত যে তিনি ছিলেন একজন 'রাজর্ষি'। 
   এই রামগানকে কেন্দ্র করেই বাল্মীকি তুলে ধরেন শ্রীরামের বংশপরিচয়।
    যদিও রামায়ণের মূল কাহিনী মূলতঃ শ্রীরামের জীবনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে, ঋষি বাল্মীকি মহাকাব্যে তাঁর  পূর্বপুরুষদের বিশদভাবে উল্লেখ করেছেন। রামায়ণে শ্রীরামের বংশের কথা এই রামগান ছাড়াও ঋষি বশিষ্ঠ দুবার বর্ণনা করেছেন  - প্রথমে শ্রীরাম ও সীতার বিয়েতে এবং তারপর আবার চিত্রকূটে, যখন ভরত শ্রীরামকে অযোধ্যায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে রাজি করাতে চেষ্টা করছিলেন।
    অযোধ্যার এই  রাজবংশের সবচেয়ে বিখ্যাত পূর্বপুরুষ ছিলেন মনুর পুত্র এবং বিবস্বান তথা সূর্যের নাতি রাজা ইক্ষ্বাকু ; সূর্যের নাতি হওয়ায় ইক্ষ্বাকুর বংশকে সূর্যবংশ বা সৌর রাজবংশ বলা হত।  আবার ইক্ষ্বাকুর নাম অনুসারে তাঁর বংশের নাম সুবিখ্যাত ছিল ইক্ষ্বাকু বংশরূপে।  
     ইক্ষ্বাকু রাজবংশের আরেক মহান রাজা রঘুর নাম অনুসারে তাঁর রাজবংশকে রঘুবংশও বলা হয়।  ইক্ষ্বাকুর অন্যান্য বিখ্যাত বংশধর এবং শ্রীরামের পূর্বপুরুষরা হলেন  ত্রিশঙ্কু, সগর, দিলীপ, ভগীরথ, কাকুস্থ, প্রবৃদ্ধ এবং দশরথ। এই রাজবংশের রাজা ভগীরথের মাধ্যমেই পৃথিবীতে গঙ্গা নদীর অবতরণ হয়েছে। অর্থাৎ দশরথের বংশ যে সেইসময়কার সবচেয়ে সমৃদ্ধ বংশ ছিল তা বোঝাই যাচ্ছে।
    কিন্তু নামখ্যাতি যশ অর্থ সুখ সব থাকলেও রাজা দশরথের ছিল না কোন পুত্রসন্তান। তাই তাঁর মন এক অব্যক্ত অশান্তিতে পূর্ণ থাকত। তবে সব সমস্যার সমাধান তো থাকেই। এক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম হল না। মন্ত্রীদের পরামর্শে তিনি অশ্বমেধ তথা পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করবেন বলে মনস্থ করেন। এই যজ্ঞে পৌরহিত্য করার জন্য তিনি তাঁর সুহৃদ রাজা লোমপাদের সঙ্গে দেখা করে তাঁর জামাই ঋষি ঋষ্যশৃঙ্গকে সস্ত্রীক আমন্ত্রণ জানালেন অযোধ্যায়। ঋষিও সানন্দে সম্মত হলেন।
   যথাসময়ে ঋষ্যশৃ‌ঙ্গকে সঙ্গে নিয়ে দশরথ অযোধ্যায় প্রবেশ করলেন। ঋষ্যশৃঙ্গের আগমনে অযোধ্যাবাসীরা অত্যন্ত আনন্দিত হ'ল। 
যথাসময় বসন্তকাল উপস্থিত হ'ল দেশে। তখন রাজা দশরথ ঋষ্যশৃঙ্গকে প্রণাম ক'রে যজ্ঞের প্রধান যাজকরূপে বরণ করলেন এবং বশিষ্ঠ বামদেব প্রভৃতি ঋত্বিক ব্রাহ্মণদেরও যজ্ঞের সংকল্প জানালেন। তাঁরা সকলে দশরথকে সাধুবাদ দিলেন এবং সরযূর উত্তর তীরে যজ্ঞভূমি নির্মাণ করে যজ্ঞের অশ্বকে বন্ধনমুক্ত করতে বললেন। দশরথ বিরাট সৈন্যবাহিনী সেই অশ্বের সঙ্গে পাঠালেন। আর অমাত্যদের যথাবিধি সমস্ত আয়োজন করবার ভার দিলেন। এক বছর ধরে চলল এই আয়োজন।
   যথাসময় বছর ঘুরে পরবর্তী বসন্তকাল এসে গেল। তখন দশরথ মহর্ষি বশিষ্ঠকে বললেন, "গুরুদেব, আপনি যথাবিধি আমার যজ্ঞ সম্পাদন করুন। যাতে যজ্ঞের কোনও অঙ্গে বিঘ্ন না হয় তার বিধান করুন।"
   রাজাকে আশ্বস্ত করে বশিষ্ঠ স্থপতি, শিল্পকার, সূত্রধর, খনক, গণক, নট, নর্তক এবং শুদ্ধস্বভাব শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতগণকে ডেকে আনিয়ে রাজার আজ্ঞানুসারে  
সব ব্যবস্থা করলেন এবং পৃথিবীতে যত ধার্মিক রাজা আছেন তাঁদের নিমন্ত্রণ পাঠালেন। যথাসময়ে শুভনক্ষত্রযুক্ত দিনে রাজা দশরথ যজ্ঞভূমিতে গেলেন এবং পত্নীগণসহ যজ্ঞে দীক্ষিত হলেন।
   ইতিমধ্যে যে যজ্ঞাশ্ব এক বছর আগে ছাড়া হয়েছিল তা সমগ্র আর্যাবর্ত ঘুরে ফিরে এল। এবার বশিষ্ঠসহ দ্বিজগণ ঋষ্যশৃঙ্গকে সামনে রেখে শাস্ত্রানুসারে যজ্ঞ আরম্ভ করলেন। দেবতাদের উদ্দেশে যে সকল পশুপক্ষী অশ্ব ও জলচর সংগৃহীত ছিল সে সমস্তই ঋষিগণ যথাবিধি বধ করলেন। যুপকাঠে তিনশো পশু এবং রাজা দশরথের অশ্বমেধের উৎকৃষ্ট অশ্ব বাঁধা ছিল। কৌশল্যা সেই অশ্বের সম্যক পরিচর্যা ক'রে  তিন খড়গাঘাতে তাকে বধ করলেন। তার পর তিনি ধর্মকামনায় সুস্থিরচিত্তে সেই নিহত অশ্বের সঙ্গে এক রাত যাপন করলেন। কৈকেয়ী এবং সুমিত্রা সঙ্গে রইলেন।
শ্রৌতকর্মে নিপুণ ঋত্বিক সেই অশ্বের শব নিয়ে যথাশাস্ত্র হোম করলেন। ষোল জন ঋত্বিক অশ্বের সমস্ত অঙ্গ অগ্নিতে আহুতি দিলেন। যজ্ঞ শেষ হল যথাসময়ে। তারপর দশরথ যাজক ও অন্যান্য ব্রাহ্মণদের প্রচুর দক্ষিণা দিলেন। সকলেই হৃষ্ট মনে রাজাকে আশীর্বাদ করতে লাগলেন। এরপর ঋষ্যশৃঙ্গ অথর্বোক্ত মন্ত্রে যথাবিধি পুত্রেষ্টি যজ্ঞ আরম্ভ করলেন।
   যে সময়ে রাজা দশরথ এই যজ্ঞ করছিলেন তখন দেবলোকে চলছিল ত্রিভুবন রক্ষার প্রচেষ্টা। এই সময়ে লঙ্কার রাজা রাবণের অত্যাচারে ত্রিভুবন ছিল কম্পিত। তাই দেবতারা তখন ব্রহ্মার কাছে গিয়ে বললেন, "ভগবান, রাক্ষসরাজ রাবণ আপনার বরে বলীয়ান হয়ে আমাদের পীড়ন করছে, তার বিনাশের উপায় স্থির করুন।"
    উত্তরে ব্রহ্মা বললেন, "রাবণ আমার কাছে বর চেয়েছিল যে গন্ধর্ব যক্ষ দেব দৈত্য নাগ গরুড় ও রাক্ষসের হাতে যেন তার মৃত্যু না হয়। আমিও তাকে সেই বর দিয়েছি। সে অবজ্ঞাবশে মানুষের নাম করে নি। তাই  সেই মানুষরূপে ভগবান বিষ্ণুই তাকে বধ করবেন।"
   অতঃপর দেবতারা বিষ্ণুর স্মরণ নেন। তখন শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী গরুড়বাহন বিষ্ণু সেখানে আবির্ভূত হন। দেবগণ স্তব করে তাঁকে বলেন, " প্রভু, ত্রিভুবনের হিতকামনায় আমাদের একটি প্রার্থনা আপনার কাছে আছে। বর্তমানে অযোধ্যাপতি দশরথ পূত্রেষ্টি যজ্ঞ করছেন। তাঁর  তিন মহিষী আছেন। আপনি কৃপা করে চার অংশে বিভক্ত হয়ে সেই তিন মহিষীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করুন এবং মানুষ রূপে অবতীর্ণ হয়ে দেবতাদের অবধ্য দুরাচারী রাবণকে বধ করুন। সেই রাক্ষস আমাদের সকলের উপর অকথ্য অত্যাচার করছে। তাই তার নিধনের জন্য আমরা আপনার শরণাপন্ন হয়েছি।"
  বিষ্ণু তখন তাঁদের অভয় দিয়ে বললেন, "তোমরা ভীত হয়ো না। আমি রাবণকে অবশ্যই সবংশে সংহার করব।"
  অন্যদিকে তখন ঋষ্যশৃঙ্গের উপদেশ অনুসারে দশরথ যজ্ঞ করছিলেন। যথাসময় যজ্ঞাগ্নি থেকে আবির্ভূত হলেন কৃষ্ণকায়, রক্তাম্বরধারী,  শুভলক্ষণসম্পন্ন, দিব্য আভরণে ভূষিত এক বিরাট মূর্তি। তাঁর হাতে ছিল তপ্তকাঞ্চনগঠিত রজতাবরণযুক্ত দিব্য পায়সে পরিপূর্ণ এক বিরাট পাত্র।
যজ্ঞাগ্নি থেকে উত্থিত ব্যক্তি রাজা দশরথকে বললেন, "আমি প্রজাপতিপ্রেরিত পুরুষ। মহারাজ, এই দেবনির্মিত সন্তানদায়ক পায়স আপনার পত্নীদের খেতে দিন।"
  দশরথ সেই পাত্র মাথায় ঠেকিয়ে গ্রহণ করলেন এবং অন্তঃপুরে এসে পায়সের অর্ধাংশ কৌশল্যাকে দিলেন। অবশিষ্ট অর্ধেকের অর্ধাংশ সুমিত্রাকে দিলেন। অবশিষ্টের অর্ধ কৈকেয়ীকে দিয়ে মনে মনে বিবেচনার পর শেষ অংশ আবার সুমিত্রাকেই দিলেন। অর্থাৎ ১৬ ভাগের ৮ ভাগ কৌশল্যা, ৬ ভাগ সুমিত্রা, এবং ২ ভাগ কৈকেয়ী পেলেন। তিন রানী সেই পায়স খেয়ে অচিরে গর্ভধারণ করলেন।
  অশ্বমেধ যজ্ঞ শেষ হবার পর নিমন্ত্রিত রাজারা, অন্যান্য অতিথিরা এবং সপত্নীক ঋষ্যশৃঙ্গ নিজ নিজ দেশে ফিরে গেলেন। এর বারো মাস পূর্ণ হবার পর মহারানী কৌশল্যা চৈত্রের নবমী তিথিতে পুনর্বসু নক্ষত্রে শ্রীরামকে প্রসব করলেন। তারপর রানী কৈকেয়ী পুষ্যা নক্ষত্রে ভরতকে এবং রানী সুমিত্রা অশ্লেষা নক্ষত্রে লক্ষণ-শত্রুঘ্নকে প্রসব করলেন।  অযোধ্যায় নানাপ্রকার উৎসব আরম্ভ হ'ল। জন্মের এগার দিন পরে বশিষ্ঠ রাজকুমারদের নামকরণ করলেন।
   সময়ের সাথে সাথে রাজকুমারদের সকলেই বড় হয়ে উঠলেন। তাঁরা সকলেই  হয় উঠলেন মহাবীর, লোকহিতে রত, জ্ঞানবান ও গুণবান। তেজস্বী পরাক্রমশালী শ্রীরাম নির্মল শশাঙ্কের মত সকলের প্রাণপ্রিয় ছিলেন। তিনি হাতি ঘোড়া ও রথ চালনায় যেমন পটু ছিলেন তেমনিই ছিলেন ধনুর্বিদ্যায়  পারদর্শী। আর পিতার সেবা শুশ্রুষায়  ছিল তাঁর অসীম অনুরাগ।
    লক্ষ্মণ  ছোটবেলা থেকেই সবসময় শ্রীরামের ছায়ার মত থাকতেন এবং তিনি শ্রীরামের দ্বিতীয় প্রাণতুল্য ছিলেন। ভরত শত্রুঘ্নর মধ্যেও সেইরকম স্নেহের ও প্রীতির সম্বন্ধ গড়ে উঠল।
     অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে রাবণ বধের জন্যেই শ্রীরামচন্দ্রের আবির্ভাব হয়েছিল ধরাধামে। আর বিভিন্ন রামায়ণের সংস্করণে রাম রাবনের যুদ্ধকে আর্য অনার্যের সংগ্রাম বলে মনে করা হয়। একটি জনপ্রিয় তত্ত্ব আছে যে আর্য শব্দটি ফর্সা-বর্ণের লোকদের একটি জাতিকে বোঝায় যারা ইউরোপের তৃণভূমি থেকে ভারতীয় উপদ্বীপে এসেছিল।  তারা বৈদিক সংস্কৃতি নিয়ে এসেছেন এই দেশে এবং তাঁদের মাধ্যমেই সরস্বতী-সিন্ধু সভ্যতার আদি বাসিন্দা দ্রাবিড়দের বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে। এটি আর্য অভিবাসন তত্ত্ব নামে পরিচিত।  তাই অনেক গবেষকের মতে রাম এবং রাবণের যুদ্ধ ধর্মের চেয়ে আর্য এবং দ্রাবিড়দের মধ্যে জাতিগত দ্বন্দ্বের সাথে অধিক সম্পর্কযুক্ত।
  তবে, রামায়ণে আর্য-দ্রাবিড় দ্বন্দ্ব আরোপিত হলেও এই মহাকাব্যে আর্য এবং অনার্য শব্দগুলি কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তা লক্ষ্য করার মতো।
এই দুটি শব্দই রামায়ণে একাধিকবার এসেছে। আর্য শব্দটি ধারাবাহিকভাবে ভদ্র মানুষজনের  গুণ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে - এ হল এমন একটি আচরণ যা সভ্য মানুষদের কাছে প্রত্যাশিত।
    অনেকেই বলেন যে এই আর্যরা কেবল নিজেদের সভ্য বলে মনে করত এবং তাই এই গুণটিকে তাদের নিজস্ব জাতির সমার্থক বলে মনে করত।  যদি আমরা যুক্তির এই লাইনটি মেনে নিই, তাহলে বোঝা যাবে যে ত্রেতা যুগে ভারতীয় উপদ্বীপের উত্তর থেকে দক্ষিণে সুর্যবংশ, রাবণের রাক্ষস বংশ এবং সেই সাথে বানর উপজাতির সবাই ছিল আর্য। সবাই ইতিবাচকভাবে একই জাতির অন্তর্গত। এর স্বপক্ষে একাধিক প্রমাণ মেলে।        প্রথমত, রাজা দশরথ রামের নির্বাসন চাওয়ার জন্য নিজের রানী কৈকেয়ীকে অনার্য বলেন।  
    দ্বিতীয়ত জনস্থানে মারীচের কণ্ঠে  " হায় লক্ষ্মণ" শুনেও শ্রীরামের সাহায্য করার জন্য ছুটে না আসার জন্য সীতা স্বয়ং তাঁর দেওর লক্ষ্মণকে অনার্য বলেন।
     তৃতীয়ত, রাবণ এবং ইন্দ্রজিৎ রামের পক্ষে চলে যাওয়ার জন্য বিভীষণকে অনার্য বলেন।
    চতুর্থত, রাবণ যুদ্ধে শ্রীরামের শরাঘাতে অচেতন হয়ে পড়লে তার সারথি যখন তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিয়ে পালিয়ে যান তখন রাবন কাপুরুষতা দেখানোর জন্যে সারথীকে অনার্য বলেন।
  পঞ্চমত, সীতা দেবী হনুমানকে রাক্ষসীদের হত্যা না করার জন্য অনুরোধ করেন কারণ তারা কেবল রাবণের আদেশ পালন করছিল।  এদের মত আজ্ঞাবাহীদের হত্যা কোন আর্যদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়। 
   এছাড়া রামায়ণ পড়লে আমরা দেখব যে মন্দোদরী এবং রাবণের অন্যান্য স্ত্রীরা তথা রাক্ষসবাহিনীর সেনাপতিরাও রাবণকে আর্য এবং আর্যপুত্র  বলে উল্লেখ করেছেন। বানরদের রানী তারা তাঁর স্বামী বালীকে  আর্য সম্বোধন করেছেন। অর্থাৎ রামায়ণ অনুসারে আর্য কোন ভদ্রলোকের বিশেষণ বোঝাতে   ব্যবহৃত হয়েছে এবং অনার্য কোন অসভ্য, প্রতারক, ভীরু ব্যক্তিকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।
  এছাড়া অযোধ্যায় যেমন বৈদিক মত অনুসারে যজ্ঞ করতে দশরথ ও শ্রীরামকে দেখা গেছে তেমনি লঙ্কায় রাবণ, ইন্দ্রজিতকেও দেখা গেছে বৈদিক মন্ত্র অনুসারে যজ্ঞ করতে। তাই রামায়ণের যুগে এই রাম রাবনের যুদ্ধ কোন আর্য অনার্যের যুদ্ধ নয়। এটি ছিল শুভ শক্তি ও অশুভ শক্তির মধ্যে যুদ্ধ। আর এরা সকলেই নিজেদের আর্য মানতেন।
   যাহোক আবার কাহিনীতে ফেরা যাক।  যথাসময়ে রাজা দশরথের চার পুত্র বড় হয়ে উঠলেন সানন্দে। তবে শ্রীরামচন্দ্র ষোলো বছরে পদার্পণ করার আগেই তাঁর জীবনে এল এক নতুন অভিযানের সুযোগ। 
                       (ক্রমশ)


  #বাল্মিকী #রামায়ণ #valmiki #ramayana #rama #sita #ravan #আধ্যাত্মিক #devotion #epic #মহাকাব্য

Monday 18 March 2024

সত্যের আলোয় বাল্মীকি রামায়ণ - তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়। এক - শ্রীরামের জন্মের আগে রামায়ণ রচনা হয়নি আর প্রচলিত মত অনুযায়ী বাল্মীকিও কোন দস্যু রত্নাকর ছিলেন না।

সত্যের আলোয় বাল্মীকি রামায়ণ
     - তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়।

         বালকান্ড 

এক - (সর্গ ১-৪)  - শ্রীরামের জন্মের আগে রামায়ণ রচনা হয়নি আর প্র চলিত মত অনুযায়ী বাল্মীকিও কোন দস্যু রত্নাকর ছিলেন না।

 *                *                 *

 মহাকবি বাল্মীকির রামায়ণ রচনার সূত্রপাত হয় তমসা নদীর তীরের একটি তপোবনের আশ্রমে। সেখানেই ঋষি বাল্মীকি তাঁর শিষ্যদের নিয়ে থাকতেন। এই তপোবনে একদিন দেবর্ষি নারদ দেখা করতে এলেন ঋষির সঙ্গে। সেইসময় দুজনের মধ্যে নানা বিষয়ে  বার্তালাপ হয়। কথাপ্রসঙ্গে ঋষি বাল্মীকি তখন ত্রেতা যুগের শ্রেষ্ঠতম রাজার নাম জানতে চাইছিলেন যাঁর মধ্যে কাম্য ষোলটি কলা সম্পূর্ণভাবে রয়েছে।  তাই তিনি দেবর্ষির কাছে জানতে চাইলেন, "সমসাময়িক সময়ে  গুণ, বীরত্ব, ধর্ম, কৃতজ্ঞতা, দৃঢ়তা এবং দৃঢ় সংকল্পে সমৃদ্ধ এমন কোন পণ্ডিত, যোগ্য এবং  সুদর্শন
পুরুষ কি আছেন যিনি অনবদ্য চরিত্রের অধিকারী এবং চিরকাল সকল প্রাণীর কল্যাণে নিবেদিত? এমন কেউ কি আছেন এই সময়ে
যিনি সকল প্রকার পরিস্থিতিতে সংযম বজায় রাখেন, নিজের ক্রোধের উপর বিজয়লাভ করেছেন, যাঁর মনে কোন হিংসা নেই   এবং যখন তিনি রাগান্বিত হন, স্বর্গের দেবতারাও ভয় পেয়ে যান?"
    নারদ তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, "বর্তমানে এমন একজন ব্যক্তিই আছেন যাঁকে আমরা জানি, যিনি সত্যিই আপনার বর্ণনার মতই মহান।  তিনি হলেন অযোধ্যার রাজা শ্রীরামচন্দ্র। ইক্ষ্বাকু  বংশে জন্মগ্রহণ করেছেন তিনি।"
    রামায়ণ রচনার আগে ঋষি বাল্মীকির এই প্রশ্ন প্রমাণ করে যে শ্রীরামের জন্মের আগে তিনি রামায়ণ লেখেন নি। তিনি ছিলেন শ্রীরামের সমসাময়িক। আর সেইসময়কার রাজা শ্রীরামের  কথা প্রথম তিনি শোনেন দেবর্ষি নারদের কাছে। তাই শ্রীরামের জন্মের আগে রামায়ণ রচনার প্রবাদ সম্পূর্ণ কাল্পনিক।
    অতঃপর দেবর্ষি নারদ শ্রীরামের জীবনকাহিনী সংক্ষেপে বর্ণনা করলেন বাল্মীকির কাছে - তাঁর জীবনে অপ্রত্যাশিত বনবাস, বনে প্রায় চৌদ্দ বছর যাপন, পরাক্রমী রাক্ষস রাজা রাবণের দ্বারা তাঁর স্ত্রী সীতার অপহরণ, রামের পত্নীবিরহের শোক, বানরদের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব, সমুদ্রের উপর সেতু নির্মাণ, রাবন বধ, লঙ্কা জয় এবং অবশেষে অযোধ্যায় ফিরে সিংহাসনে রাজ্যাভিষেক। সবই নারদ খুলে বলেন তাঁকে।  
   নারদ চলে যাওয়ার পর, ঋষি স্নানের জন্য তমসার তীরে গেলেন।  সেখানে তাঁর চোখে পড়ল -  একজোড়া ক্রৌঞ্চ পাখি একে অপরের সাথে মিলনের আনন্দে পূর্ণ হয়ে রয়েছে।

 হঠাৎ একজন শিকারী সেখানে এসে উপস্থিত হয় এবং আড়াল থেকে তীর নিক্ষেপ করে পুরুষ ক্রৌঞ্চটির উপরে। ক্রৌঞ্চ নিহত হয়ে রক্তাক্ত দেহে মাটিতে পড়ে ছটফট করতে থাকে আর তাই দেখে তার স্ত্রী ক্রৌঞ্চী প্রবল বিরহে করুণস্বরে আকুলভাবে কাঁদতে লাগল। ঋষি বাল্মিকি শিকারীর এই নিষ্ঠুর কাজ দেখে গভীরভাবে ব্যথিত হন। দুটি পাখির মিলনক্ষণ এভাবে যন্ত্রণায় ভরিয়ে দেয়ার জন্যে এবং নারী  ক্রৌঞ্চটিকে এমনভাবে বিরহযন্ত্রণায় নিমজ্জিত করার জন্য তিনি প্রবল ক্রোধে শিকারীকে অভিশাপ দেন, "ওহে শিকারী, মাংসের লোভে মোহিত হয়ে তুমি যেভাবে ক্রৌঞ্চ দম্পতির একটিকে মেরে দ্বিতীয়টিকেও প্রবল যন্ত্রণায় বিদ্ধ করেছ, তাতে আমি বলছি - তুমিও জীবনে কখনো সুখ পাবে না। আজীবন মানসিক শান্তি থেকে বঞ্চিত হবে তুমি।"
    কিন্তু এই অভিশাপ বাক্য উচ্চারণ করেই বাল্মীকির মনে জাগল এক অন্য ভাব - তিনি নিজের অভিশাপের  শ্লোকটির গঠন স্মরণ করে  বিস্মিত হয়ে গেলেন। তাঁর মনের ভাব তিনি ব্যক্ত করলেন তাঁর এক শিষ্য ভরদ্বাজের কাছে। এই শ্লোকটি তাঁর সামনে উপস্থাপন করে বললেন, "এই অভিশাপ দিতে গিয়ে আমি যে শব্দগুলি উচ্চারণ করেছি তা অদ্ভুতভাবে চারটি অংশের একটি কাব্যিক ছন্দে আপনা থেকেই রচিত হয়ে গেছে। এই যে চরণবদ্ধ সমান অক্ষর বিশিষ্ট তন্ত্রীলয়ে গানের যোগ্য বাক্য আমার শোকাবেগে উৎপন্ন হয়েছে তা নিশ্চয়  একসময়  শ্লোক নামে খ্যাত হবে।"    
শিষ্য ভরদ্বাজ সানন্দে সেই শ্লোকটি মনের মাঝে গেঁথে নিলেন।

 ঋষি বাল্মীকির উচ্চারিত মূল সংস্কৃত ছন্দটি ছিল -

মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ। 

যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্ ॥

 এই ঘটনার পর ঋষি বাল্মীকি নিজের আশ্রমে ফিরে আসেন। তাঁর মন তখন তাঁর প্রত্যক্ষ করা দুঃখজনক ঘটনা এবং তাঁর উচ্চারিত শ্লোকটি নিয়েই চিন্তামগ্ন ছিল। সম্ভবত তাঁকে আশ্বস্ত করতে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা তাঁর সামনে আবির্ভূত হলেন।  

তিনি বাল্মীকিকে বললেন, 'তুমি যা রচনা করেছেন তা আসলে একটি শ্লোক। এই শ্লোকের ছন্দ হল অনুষ্টুপ যা খুবই সহজে সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য ব্যবহার করা যায়।  অনুষ্টুপ ছন্দ এরকমই বত্রিশটি অক্ষর নিয়ে গঠিত। আমার ইচ্ছাতেই এই শ্লোক ছন্দে রচিত হয়েছে তোমার মাধ্যমে। কারণ আমি চাই তোমার মাধ্যমে রচিত হোক শ্রীরামের উপর এক মহাকাব্য। তুমি নারদের থেকে  শ্রীরামের যে জীবনচরিত শুনেছ সেই ঘটনাবলী সাজিয়ে একটি মহাকাব্য রচনা কর এরকম শ্লোকের মাধ্যমে। তুমি  জগতের কাছে  শ্রীরামের মহিমান্বিত জীবনচরিত প্রকাশ কর।  যা এখন অবধি শ্রীরাম বিষয়ে তোমার অবিদিত আছে সে সমস্তও তোমার তোমার বিদিত হবে। তোমার এই রচনায় কোনও বাক্য মিথ্যা হবে না। আর যত কাল ভূতলে গিরি নদী সকল অবস্থান করবে তত কাল রামায়ণকথা লোকসমাজে প্রচারিত থাকবে। আর যত কাল তোমার রচিত রামের আখ্যান পৃথিবীতে প্রচারিত থাকবে তত কাল তুমিও আমার জগতের উর্ধ্ব ও অধোলোকে বাস করবে। 
  এই দৈব আদেশের পর ঋষি বাল্মীকি দৃঢ় সংকল্প নেন  রামায়ণ রচনার জন্যে।

 কিন্তু সংকল্প নিলেই তো হল না। আগে যে সম্যকভাবে জানতে হবে শ্রীরামের জীবনচরিত। অতএব এবার ঋষি বাল্মীকি শ্রীরামের মহাজীবনের বিস্তারিত বিবরণ জানতে গভীর ধ্যানে বসেন। আপন যোগশক্তির বলে ধ্যানের মাধ্যমে তিনি শ্রীরামের জীবনের ঘটনাগুলিকে নিজের চোখের সামনে দেখতে থাকেন, ঘটনাপ্রবাহ ঠিক যেমনটি ঘটেছিল। আর তারপর শুরু হয় তাঁর রামায়ণ রচনা।
এইভাবে বাল্মীকির হাত দিয়ে রামায়ণ রচিত হয়েছিল। এই রামায়ণ হল ভারতবর্ষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস। ত্রেতাযুগের সেই ফেলে আসা সময়ের পূর্ণাঙ্গ চিত্র উঠে এসেছে এই ইতিহাসের মাধ্যমে। বাল্মীকি ঋষি এই ইতিহাস চব্বিশ হাজার শ্লোক, পাঁচশ সর্গ রচনা করেন ছয় কাণ্ডে।
    ইতিহাস রচনার পর ঋষি বাল্মীকির প্রয়োজন ছিল এমন কোন সঠিক শিষ্যকে নির্বাচন করা যিনি মহাকাব্যটি স্থানীয় নগর গ্রামের শ্রোতাদের কাছে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারেন।  তিনি যখন এই কথা ভাবছিলেন, তখন তাঁর দুই শিষ্য লব ও কুশ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন।  এই অল্পবয়সী ছেলেদুটি ছিল প্রখর বুদ্ধিমান, গুণী, বেদে পারঙ্গম এবং সঙ্গীতে পারদর্শী। 
   বাল্মীকি যখন দুই ভাইকে শেখাতে লাগলেন তখন তিনি দেখলেন - তাঁরা পাঠে ও গানে  দ্রুত মধ্য ও বিলম্বিত এই তিন মানে এবং ষড়জ ঋষভ প্রভৃতি সপ্ত স্বরে বীণাদি তন্ত্রীবাদ্যের সমলয়ে বড় সুন্দরভাবে এই কাব্য গাইতে লাগলেন। তিনি দেখলেন - এই দুই ভাই গান্ধর্ব বিদ্যা এবং স্বরের উচ্চারণস্থান ও মূর্ছনায় অভিজ্ঞ। তাদের কণ্ঠস্বর সুমধুর। তাঁরা গন্ধর্বদের মতই সুন্দর এবং রূপলক্ষণসম্পন্ন। 
বাল্মীকির তখন দুইজনকে দেখে মনে হয় -  পৃথিবীতে বিষ্ণুর প্রতিচ্ছবি যেমন শ্রীরাম তেমনিই লব এবং কুশ দুজনেই যেন স্বয়ং শ্রীরামের প্রতিবিম্বের মত। তাই রামায়ণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার ধারক ও বাহক রূপে এই দুই শিষ্য তাঁকে যথাযথ সহায়তা করবে।
   অতএব ঋষি বাল্মীকি এরপর লব ও কুশকে তাঁর লেখা রামায়ণ মুখস্থ করান।  দুজনেই মহাকাব্যটিকে সম্পূর্ণ গভীরতায় আত্মস্থ করে নেয় এবং তারপর তারা দিকে দিকে এই রামায়ণ গান ছড়িয়ে দিতে থাকে। অন্তরের আবেগ দিয়ে তারা  অযোধ্যার শহর ও গ্রামের অধিবাসীদের কাছে শ্রীরামের জীবন আলেখ্য তুলে ধরতে থাকে এই রামায়ণ গানের মাধ্যমে।
    এইসময় একদিন ঋষি বাল্মীকি শুনলেন যে শ্রীরামচন্দ্র অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে চলেছেন। সেই  যজ্ঞতে অংশগ্রহন করতে দুর দূরান্ত থেকে অযোধ্যায়  অতিথিরা আসছিলেন।  ঋষি বাল্মীকিও লব কুশ সহ তাঁর অন্য শিষ্যদের  সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন অযোধ্যায়।  সেইসময় একদিন লব ও কুশ  অযোধ্যার পথে পথে যখন রামায়ণ গান গেয়ে শোনাচ্ছিল তখন শ্রীরাম প্রাসাদের অলিন্দ থেকে তাদের দেখতে পান।  তিনিই লব ও কুশকে এই রামায়ণ গান গাইতে তার প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানান। যথাসময়ে
 লব ও কুশ শ্রীরামের সামনে এসে গাইতে শুরু করেন তাঁর জীবন আলেখ্য রামায়ণ।

লব ও কুশের রামায়ণ গান সেদিন যেমন অযোধ্যার রাজদরবারে জাগিয়েছিল আনন্দের স্পন্দন, আজও এই রামায়ণ গান একইভাবে আনন্দের স্পন্দন জাগায় যেখানেই তা অনুষ্টুপ ছন্দের সুরে গাওয়া হয়। ঋষি বাল্মীকি বলেছেন যে এই মহাকাব্যটির গান শুনলেই শ্রোতারা পুণ্য লাভ করে কারণ রামায়ণ কেবল শ্রীরাম, লক্ষ্মণ, সীতার  জীবনী সম্বলিত একটি মহাকাব্য নয়, এই  মহাগ্রন্থ পাঠ জীবনকে উদ্দীপিত করে বেদের জ্ঞান ও বেদান্তের শিক্ষায়, মানুষকে দেখায় আলোর দিশায় চলার পথ।

 রামায়ণ সম্পর্কে বলা হয়েছে:

 "कामार्थगुणसंयुक्तं धर्मार्थगुणविस्तरम् |

 समुद्रमिव रत्नाढ्यं सर्वश्रुतिमनोहरम् ||"
  
এইভাবে শুরু হয়েছে বাল্মীকির রামায়ণ। এই মূল রামায়ণে ঋষি বাল্মীকি সম্পর্কে খুব কম তথ্য পাওয়া যায়। এখানে শুধু বলা হয়েছে যে তিনি একজন বিখ্যাত ঋষি এবং যোগী, যিনি তমসা নদীর তীরে একটি আশ্রমে থেকে সাধনা করতেন এবং শিষ্যদের পাঠ দিতেন।   বনবাসের সময়  শ্রীরাম, সীতা এবং লক্ষ্মণ চিত্রকূটে যাওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। 
      বাল্মীকি যে আগে দস্যু রত্নাকর ছিলেন এবং তাঁকে রাম নাম দেয়ার পর "মরা মরা" জপ করতেন এরকম কোন গল্প মূল রামায়ণে নেই। এগুলো সবই উত্তরকালে সংযোজিত হয়েছে। 
   শুধু রামায়ণের উত্তরকাণ্ডতে (এই উত্তরকাণ্ডও কিন্তু বাল্মীকি রচিত নয়। পরবর্তীকালের সংযোজন।)  রয়েছে - ঋষি বাল্মীকি নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে  বলছেন যে তিনি প্রচেতার দশম পুত্র এবং বহু বছর ধরে তীব্র তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ করেছেন৷

 আর স্কন্দপুরাণ অনুসারে জানা যায় - ঋষি বাল্মীকি  পূর্বজন্মে একজন শিকারী ছিলেন।  ঋষি শঙ্খের সাথে একটি সাক্ষাৎ তাঁর জীবনধারা বদলে দেয়।  ঋষি শঙ্খ তাঁকে কানে রামনাম  দিয়েছিলেন।  রামনামের নিয়মিত জপের ফলে পরবর্তী জন্মে তিনি ঋষি বাল্মীকির পুত্র রূপে জন্মগ্রহণ করেন আর  বাল্মীকির পুত্র হওয়ায় তিনিও বাল্মীকি নামে পরিচিত ছিলেন। স্কন্দপুরান মতে তিনিই রামায়ণ রচনা করেন। 
    অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে বাল্মীকির সম্বন্ধে পরবর্তীকালে নানা মুনির নানা মত প্রকাশ পেয়েছে। তবে যেহেতু আমরা এখানে একনিষ্ঠভাবে এই লেখায় শুধুমাত্র বাল্মীকি রামায়ণ অনুসরণ করে রামায়ণকে জানব তাই অন্য সমস্ত পরবর্তীকালে সংযোজিত কাহিনী ত্যাগ করে বাল্মীকির মত অনুযায়ী বলব যে রামায়ণের রচয়িতা বাল্মীকি ছিলেন একজন মহান ঋষি যিনি তাঁর জীবদ্দশায় শ্রীরামের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। আর শ্রীরামের জন্মের আগে তিনি রামায়ণ লেখেন নি। শ্রীরামের জীবদ্দশায় ঘটে যাওয়া কাহিনী নিয়েই তাঁর রামায়ণ রচনা। পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে আমরা দেখব কিভাবে সত্যিকারের রামায়ণকে তুলে ধরা হয়েছিল জগতবাসীর সামনে আর পরবর্তীকালের নানা অবাস্তব সংযোজন কিভাবে জগৎবাসীর চোখে রামায়ণকে হেয় করেছে নানাভাবে।
        (ক্রমশ)

#বাল্মিকী #রামায়ণ #valmiki #ramayana #rama #sita #ravan #আধ্যাত্মিক #devotion #epic #মহাকাব্য

Wednesday 13 March 2024

" অপরের ব্যবহারে কেন দুঃখ পাও?"

" অপরের ব্যবহারে কেন দুঃখ পাও?" তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়

(অনন্তের জিজ্ঞাসা - ষষ্ঠ খন্ড।)
    - তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়।

প্রশ্ন - আমাদের জীবনে আশেপাশের মানুষদের খারাপ ব্যবহারের জন্যে প্রায়ই আমাদের দুঃখ পেতে হয়। এর থেকে উদ্ধারের পথ কি?

   তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় : কোন মানুষ যদি ভাবে যে তার দুঃখের কারণ অন্য কোন ব্যক্তি তবে তার পক্ষে জীবনে সুখ পাওয়া অসম্ভব। অপরের থেকে খারাপ ব্যবহার পাওয়ার কারণে কেউ যদি নিজেকে দুঃখী ভাবে তাহলে সেই দুঃখের থেকে পরিত্রাণের কোন পথ নেই। এর কারণ হল - প্রতিটি মানুষ নিজের কর্মফল ভোগ করে, সে এই জন্মের হোক বা পূর্ব জন্মের। সামনের মানুষটির থেকে পাওয়া খারাপ ব্যবহারও তার পূর্বের কর্মফলের জন্যেই হচ্ছে। তাই জীবনে যে অবস্থাই আসুক সেটা শান্তভাবে মেনে নিতে হয়। সেইসাথে তাকে বুঝতে হয় - মানুষ কখনোই তার আশেপাশের লোকজনদের স্বভাবের পরিবর্তন করতে পারে না। সেই শক্তি তার নেই। সে শুধু পারে নিজেকে পরিবর্তন করতে এবং পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে। সেটা করতে পারলেই অনেক খারাপ সময় পেরিয়ে যাওয়া যায়।

      প্রশ্ন - কিন্তু কোন অন্য মানুষ আমাদের দুঃখের কারণ কখন হয়? 

     তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায় :  যখন আমরা অন্য কোন মানুষকে নিজের চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিই তখনই যে আমরা আশা করি যে সামনের মানুষটিও আমাকে একইভাবে গুরুত্ব দেবে। আর সেটা না দিলেই আসে হতাশা। তখনই একমাত্র সামনের মানুষটির ব্যবহার দুঃখ আনে মনে। এর একমাত্র উপায় - এরকম মানুষদের গুরুত্ব দেয়া বন্ধ করতে হয় এবং তাদের ব্যবহারের যে পরিবর্তন হবে না সেটা ধরে নিয়েই নিস্পৃহভাবে তাদের সাথে সংযোগ করতে হয়। তাহলে আর তাদের ব্যবহারের জন্যে দুঃখ পেতে হয় না। জানবে অন্য কারোর কাছে কোন বিষয়ে আশা রাখলেই আসে দুঃখ। তাই আশা না রেখে নিস্পৃহ হয়ে থাকতে পারলে সামনের মানুষটির দুর্ব্যবহার সত্বেও দুঃখ পেতে হবে না।

Sunday 3 March 2024

প্রেম আর মোহ

 সাধারণ দৃষ্টিতে মানুষ মোহকেই প্রেম বলে ভেবে নেয়। কিন্তু প্রেম আর মোহ দুইয়ের মাঝে আকাশ পাতাল ফারাক। মোহ মানুষকে ভাঙে আর প্রেম মানুষকে গড়ে। এবার দেখা যাক দুইয়ের মাঝের পার্থক্য কি ধরা দিয়েছে তারাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের চোখে !

প্রেমের প্রথম বৈশিষ্ট্যই হল - প্রেম কখনো আঘাত দেয় না। প্রেম আঘাত দিতেই পারে না কারণ প্রেম নিজেকেই অপরের করে দেয়। আঘাত দেয় মোহ। কারণ মোহ প্রেমাস্পদকে নিজের করে পেতে এবং পেয়ে সুখ লাভ করতে চায়। সেটি না হলেই সে আঘাত হানে। আর এই আঘাত নিরাময় করে প্রেম।
প্রেম আপন পথে আপন ভাবে একলাই চলে। কিন্তু মোহ সঙ্গে আনে অনেক নেতিবাদী সঙ্গী। মোহ আনে মানসিক অশান্তি - আমি ওর জন্যে এই করেছি, ও আমার জন্যে করবে না কেন? পাওনা গন্ডার হিসেব নিয়ে মোহ ব্যস্ত থাকে। প্রেম কখনো নিজের দেয়া নেয়া নিয়ে ভাবে না। সে শুধু দিয়েই খুশী। নিজেকে উজাড় করে দিয়েই তার আনন্দ।
মোহ সঙ্গে আনে মিথ্যা - কারণ মোহাবিষ্ট নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে প্রেমাস্পদের চোখে ভালো দেখাতে চায় এবং নিজের দোষ লুকিয়ে গুণটুকুই শুধু দেখায়। কিন্তু প্রেমের মধ্যে কোন বিকার নেই। প্রেম কিন্তু নিজে যেমনটি, তেমনটিই প্রেমাস্পদের সামনে তুলে ধরে ভালো মন্দ নির্বিশেষে।
মোহ আনে ঈর্ষা - প্রেমাস্পদকে কেউ ভালোবাসলে বা তার কাজে কেউ সাহায্য করলেই মোহের জাগে ঈর্ষা। আর এই সাহায্যকারী মানুষটিকে যেন তেন প্রকারে আটকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মোহ। কিন্তু প্রেম নিজে ভালোবেসে এবং প্রেমাস্পদকে ভালোবাসা দিয়েই খুশী - অন্যদের নিয়ে সে ভাবে না। ভালোবাসার মানুষটি ভালো থাকলেই সে নিজেও ভালো থাকে।
মোহ আনে একাকীত্ব। কারণ মোহাবিষ্ট মানুষ সবসময় ভাবে - সে যাকে ভালোবাসছে,অপর দিক থেকে যথেষ্ট ভালোবাসা আসছে না। যেহেতু সে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাই অপরের দিকটা বোঝার অবকাশ সে পায় না। ফলে তার মনে হয় - সে অবহেলিত, অত্যাচারিত। তাই সে ধীরে ধীরে একাকীত্বের গ্রাসে পরে যায়। তার চোখে সকলে খারাপ হয়ে যায়, অন্তত যারা তার প্রশংসা নিত্য না করে। কিন্তু যে প্রেমের পথের পথিক তার কোন একাকীত্ব নেই। সে তার প্রেমাস্পদর ভাব ও ভাবনাকে মনের মাঝে সঙ্গী হিসেবে নিয়েই খুশী থাকে।
এখন একবার ভেবে দেখুন তো - এই প্রেম আর মোহের মাঝে কাকে বেছে নেয়া উচিত?